ছবি: শুভম দে সরকার
কিন্তু এই পেশেন্টের ক্ষেত্রে সত্যিই কিছু হয়ে যেতে পারে। অজ্ঞান করার পরে কী হবে আমরা কেউই জানি না। বেশ ব্লাড লস, প্রোলংড লেবার। তার উপরে অজ্ঞান করা। এগুলো খুব আনপ্রেডিক্টেবল।’’
সিস্টার একটা ছাপা ফর্ম এগিয়ে দিয়েছে সাম্যব্রতর দিকে। সাম্যব্রত কলম বার করার জন্য পাশঝোলায় হাত ঢোকালেন। একই সঙ্গে হাতে ঠেকল রেডবুক আর বিপত্তারিণীর পুজোর ফুল। আজ আর দুটির মধ্যে কোনও পার্থক্য করলেন না সাম্যব্রত। দুটিতেই হাত ছুঁইয়ে অবশেষে ব্যাগ থেকে কলম বার করে আনলেন। কাগজটা না পড়েই সই করে দিলেন। সিস্টার বলল, “বাইরে অপেক্ষা করুন। ওটি শেষ হলে আপনাকে ডেকে নেওয়া হবে।”
সাম্যব্রত বাইরে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে রাজু।
রাস্তার দোকান থেকে চা আর কেক কিনে খাচ্ছেন দু’জনে। সাম্যব্রতকে মোবাইল ফেরত দিয়ে রাজু বলল, “আপনি যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন আপনার জামাইয়ের ফোন এসেছিল। আমি ফোন ধরে বলেছি, ‘পরে ফোন করুন’। মেয়েকে চাইল। কিন্তু সে কথা বলার অবস্থায় ছিল না।”
“আগে বলোনি তো!” চায়ে চুমুক দিয়ে কল লিস্ট দেখছেন সাম্যব্রত।
“বলার অবস্থা ছিল?” কেকে কামড় দিয়েছে রাজু।
সাম্যব্রত ঘাড় নাড়লেন। সত্যিই। গত আধ ঘণ্টা যে রকম ঝোড়ো পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তাতে শ্বাস নেওয়া মুশকিল ছিল। সাম্যব্রত শ্বাস নিতে পারছিলেন না বলেই নেবুলাইজার ব্যবহার করেছেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বিহানকে ফোন করলেন তিনি। এক বার রিং হতেই বিহান ফোন ধরে বলল, “আপনি কোথায়? আপনার ফোন অন্য এক জন ধরেছিল। আমি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।”
“চিন্তার কিছু নেই,” জামাইকে নিশ্চিন্ত করতে সাম্যব্রত বললেন, “তখন একটু ব্যস্ত ছিলাম। তাই অ্যাম্বুল্যান্সের ড্রাইভার ফোন ধরেছিল। ও সব কথা ছাড়ো। দরিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তুমি কখন আসছ?”
“আমি এই তো বঙ্গবাসী হাসপাতাল থেকে বেরোলাম। কোথাও কোনও গাড়ি নেই। সনৎ আমার জন্যে একটা বাইকের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাতে করেই আমরা আসছি।”
সাম্যব্রতর চা খাওয়া বন্ধ। খালি ভাঁড় ঝুড়িতে ফেলে সিগারেট ধরিয়ে তিনি বললেন, “আমরা মানে? তোমার সঙ্গে আর কে আছে?”
“আমি আর সুদামদা। ওঁকে আপনি চিনবেন না। আমার পরিচিত।”
“সনতের পরিচিত নয় তো?”
“কেন বলুন তো?”
সাম্যব্রত জানালেন, পিটিএস স্টপে কী হয়েছিল। সনতের লোকজনদের রাস্তা অবরোধ, পথ আটকানো এবং তার সঙ্গে হাতাহাতি—সবটাই জানালেন। শুধু নিজের ভাষণ দেওয়ার কথাটা
চেপে গেলেন।
বিহান সবটা শুনে বেজায় অবাক হয়ে বলল, “এত ক্ষণে বুঝেছি!”
“কী?”
‘‘সনতের যে একটা চারচাকা আছে এটা আমি কানাঘুষোয় শুনেছিলাম। লোকে বলে ও নাকি গাড়ি নিয়ে বকুলতলায় যাতায়াত করে। আমি যা মাইনে পাই, ও তাই-ই পায়। ওই টাকায় সংসার চলে না। গাড়ি কিনল কী করে কে জানে!”
“এখন এই সব কথা ভাবার সময় নয় বিহান।”
“আমি বকুলতলা থেকে বেরনোর পরে সনৎ ওর গাড়ি নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়েছিল। আমাকে বলেনি যে গাড়িতে ফিরবে। তা হলে আমাকে লিফ্ট দিতে হত।”
সিগারেটে টান দিয়ে সাম্যব্রত বললেন, “আবারও বলছি এখন এ সব ভাবার সময় নয়। তোমাদের এক মাত্র কাজ নিরাপদে এখানে এসে পৌঁছনো। তুমি এখন কোথায়?”
“সবে ফোরশোর রোডে পড়েছি। এখানে রাস্তা শুনশান।”
“দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে যাওয়ার পরে যে রাস্তা ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে ঘুরে গেছে, সেইটা ধরো। রেড রোড হয়ে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে এসো। পিটিএসের সামনে দিয়ে না আসাই ভাল। ওখানে সনৎ তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।”
“আমরা যদি অবরোধের খানিকটা আগে বাইক থেকে নেমে পড়ে বাকি রাস্তাটা হেঁটে যাই?”
“আমি এখান থেকে কোনও পরামর্শ দেওয়ার জায়গায় নেই বিহান। ও, হ্যাঁ। একটা পরামর্শ দিতে পারি। রাস্তা থেকে সব দলের পতাকা জোগাড় করে সঙ্গে রাখো। কিশলয় পার্টি, খরাজ পার্টি, গণতান্ত্রিক মোর্চা... তিন দলেরই। প্রয়োজন মতো ব্যবহার কোরো। এই সব ছ্যাঁচড়া পলিটিকাল পার্টির সঙ্গে ডিল করতে গেলে আমাদেরও ছ্যাঁচড়া হতে হবে।”
“ভাল বলেছেন,” হাসছে বিহান, “মন্টুদা, বাইক দাঁড় করাও।”
সাম্যব্রত আগেই ফোন কেটে দিয়েছিলেন, তাই মন্টুর নাম শুনতে পাননি। পেলে বিহানকে পরামর্শ দিতেন অবিলম্বে বাইক থেকে নেমে পড়তে। মন্টুও বুঝতে দেয়নি, সে সব কথা শুনেছে।
১৪
বাইক চালাচ্ছে মন্টু। তার পিছনে সুদাম। একদম পিছনে বিহান। বাইকের আসনে এগিয়ে পিছিয়ে বসে কোনও রকমে ব্যবস্থা হয়েছে। মন্টুর মাথায় হেলমেট আছে। তার কাছে অতিরিক্ত একটা হেলমেট ছিল। সেটা সুদাম পরেছে। বিহান হেলমেটহীন। রাস্তায় পুলিশ ধরলে কী হবে কে জানে!
ফোরশোর রোড জনহীন। পুলিশ, পাবলিক বা মিলিটারি— কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে দ্রুতগতিতে বাইক যাচ্ছে।
রাস্তার ডিভাইডারে লাগানো রেলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বিহান বলল, “মন্টুদা, বাইক দাঁড় করাও।”
“কেন গো?” বাইক না থামিয়েই প্রশ্ন করেছে মন্টু, “এই সব রাস্তা যত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাওয়া যায়, ততই ভাল। ব্রিজে ওঠার পরে দাঁড়াতে বোলো। ওখানে কোনও ঝঞ্ঝাট নেই।”
“ব্রিজে এক বার উঠে গেলে আমার কাজ হবে না। তুমি প্লিজ় দাঁড়াও।” হাত বাড়িয়ে মন্টুর কাঁধ খামচে ধরেছে বিহান। বাধ্য হয়ে মন্টু বাইক দাঁড় করাল। “কী হল? পেচ্ছাব করবে?”
“না,” রাস্তার ডিভাইডারে লাগানো রেলিং-এর দিকে দৌড়েছে বিহান। এখানে গাদা গাদা পতাকা লাগানো। কিশলয় পার্টি, খরাজ পার্টি, গণতান্ত্রিক মোর্চা— সব দলেরই আছে। একটু বড় পতাকাগুলো সরু তার দিয়ে রেলিং-এর সঙ্গে আটকানো। অপেক্ষাকৃত ছোট পতাকাগুলো সুতলি দড়ি দিয়ে বাঁধা। বড় পতাকার দিকে হাত বাড়াল না বিহান। পটাপট সুতো ছিঁড়ে তিন পার্টির তিনটে করে ফ্ল্যাগ খুলে আবার বাইকের পিছনে বসল।
মন্টু বাইকে স্টার্ট দিয়েছে। হুশ করে চলে এল শিবপুরের শ্মশান। এখান থেকে ডান দিকে ঘুরলেই রিভারসাইড মল। এখানকার মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখা নিয়ে কত মান-অভিমান হয়েছিল দরিয়ার সঙ্গে! সেই সব দিনের কথা মনে পড়ায় বিহানের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। সে জিজ্ঞেস করল, “মন্টুদা, তুমি কোনও পার্টি করো না কি?”
“কেন?” বাইক চালাতে চালাতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে মন্টু।
“এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। আমি রাজনীতির কিছু বুঝি না।”
মন্টু বলল, “আমি কোন দল করি সেটা জেনে তুমি কী করবে? পাঁচ মিনিট পরেই তুমি তোমার রাস্তা দেখবে, আমি আমার রাস্তা দেখব।”
সুদাম হাসতে হাসতে বলল, “এই সব কথা বাদ দাও। সামনেই ব্রিজে ওঠার গেট। টাকা বার করো।”
টোল প্লাজ়ায় টাকা দিয়ে কুপন কাটার পরে বিহান বলল, “পতাকাগুলো আমার কাছে রাখলাম। সামনে যে দল দেখব, সেই দলের পতাকা সুদামদার হাতে ধরিয়ে দেব। সুদামদা সেটা বাইকের হ্যান্ডেলে বেঁধে দেবে। মন্টুদা, তোমার আপত্তি নেই তো?”
মন্টু কোনও কথা না বলে বাইক চালাচ্ছে। সুদাম গলা ছেড়ে গান ধরল, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে!”
গানে গানে ব্রিজ শেষ হয়ে এসেছে। বিহান বলল, “মন্টুদা, তুমি বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে চলো। যেটা ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে নেমে গেছে। আমরা রেড রোড হয়ে বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ যাব।”
মন্টু বাইকের গতি না কমিয়ে বলল, “অকারণে ঘুরপথে যাবে কেন? সামনে রাস্তা ফাঁকা।”
“না না। তুমি বাঁদিকের রাস্তা ধরো,” অনুরোধ করে বিহান। সেটা কানে না তুলে সোজা পিটিএসের দিকে এগোচ্ছে মন্টু।
দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে, অবরোধ একটা আছে। জনাদশেক গণতান্ত্রিক মোর্চার সমর্থক দলীয় পতাকা নিয়ে ডিভাইডারে বসে রয়েছে।
বিহান গণতান্ত্রিক মোর্চার পতাকা সুদামের দিকে বাড়িয়ে দিল। নিজেও একটা নিল। কিশলয় আর খরাজ পার্টির পতাকা রাস্তার ধারে ফেলে দিল। আশা করা যায়, এত দূর থেকে ওরা দেখতে
পাচ্ছে না।
মন্টু বাইকে পতাকা বাঁধতে দিল না। এখন সুদামের হাতে দুটো পতাকা। বিহানের হাতে একটা। বাইক যখন অবরোধকারীদের সামনে দাঁড়াল, তখন সুদাম আর বিহান বীরবিক্রমে পতাকা দোলাচ্ছে।
রোগাপাতলা একটা ছেলে বলল, “এখানে আমরা অবরোধ করছি। আপনারা ফিরে যান।”
বিহান বুঝল, আর কিছু করার নেই। এখানে বাইক থেকে নামতেই হবে। বাকি রাস্তা হেঁটে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। সে মন্টুর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “আমি বললাম ওই দিককার রাস্তা দিয়ে যেতে...”
সুদামও বাইক থেকে নেমে পড়েছে। একটিও কথা না বলে বাইক ঘুরিয়ে অন্য একটা লেনে উঠে ফেরার রাস্তা ধরল মন্টু। বিহান আর সুদাম সামনের দিকে এগোল।
“এ দিকে রাস্তা বন্ধ,” বলল রোগাপাতলা ছেলেটি, “আপনারা কোথায় যাবেন?”
“আমি রাস্তায় গানবাজনা করি ভাইটি,” বিহানকে বলতে না দিয়ে কথা শুরু করেছে সুদাম, “আজ ছুটির দিনে সারা শহর জুড়ে গান গাইতে গাইতে চলেছি। তোমরা শুনবে?”
“হাতে পতাকা কেন?” বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল রোগাপাতলা।
“তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি!” হাসছে সুদাম, “হ্যাঁ গো ভাই, তোমরা একাই পার্টি করবে? আমরা যারা গানটান গাই, ঘুরেটুরে বেড়াই, ভিক্ষেটিক্ষে করি, তাদের কি পতাকায় কোনও অধিকার নেই? পার্টি কি শুধু তোমাদের? আমাদের নয়?”
“অবশ্যই আপনাদের,” জানাল রোগাপাতলা, “তা আপনি এখন কী গান শোনাবেন?”
“তোমরা যে গান বলবে,” পায়ে ঘুঙুরের বোল তুলেছে সুদাম, হাতের একতারায় আঙুল চলছে।
“বলছি দাঁড়ান। তার আগে আপনার বন্ধুর সঙ্গে একটু আলাপ পরিচয় করি,” বিহানের দিকে ফিরেছে রোগাপাতলা, “আপনি কোথায় যাচ্ছেন দাদা? আপনাকে দেখে তো ঠিক রাস্তায় গান গাওয়া পার্টি বলে মনে হচ্ছে না।”
বিহান জানত, প্রশ্নটা আসবে। সে উত্তরও ঠিক করে রেখেছে। “আমরা দু’জনেই বকুলতলায় থাকি। ট্রেনে করে হাওড়া আসছিলাম। মাঝরাস্তায় জানলাম কলকাতা শহরে গন্ডগোল হয়েছে। আপ আর ডাউন। সব ট্রেন বন্ধ। বকুলতলায় ফেরার উপায় নেই। কলকাতায় আত্মীয়ের বাড়িতে রাত কাটিয়ে কাল ফিরে যাব।”
“আত্মীয়বাড়ি কলকাতার কোথায়?”
রোগাপাতলার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বিহান বলল, “আপনি কি আমাকে জেরা করছেন?”
“হ্যাঁ,” রোগাপাতলার মুখে এখনও বিনীত হাসি।
এই প্রথম বিহানের ভয় করতে শুরু করল। এই ছেলেগুলোর শরীরের ভাষা শ্বাপদের মতো। শ্বাস বন্ধ করে, থাবা গেড়ে, পেশি সঙ্কুুচিত করে অপেক্ষা করছে। একটু এ দিক-ও দিক হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। মাথা থেকে বিরক্তি আর ভয় হটিয়ে বিহান বলল, “নাগেরবাজারে আমার মামার বাড়ি।’’ সত্যি কথাই বলেছে বিহান। শ্রীরূপার বাপের বাড়ি নাগেরবাজারে।