ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ১

পরিক্রমণ

চার পাঁচটা এ ফোর কাগজের পাতা, এক দিকে লেখা, আর এক দিকে সাদা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে ভুরু কুঁচকে সামনে দাঁড়ানো দক্ষিণী নার্সের দিকে তাকায় অভিরূপ। “হোয়াট রাবিশ আর দিস? আর নট ইউ প্রপারলি লুকিং আফটার হার রিতা?” 

Advertisement

রাজশ্রী বসু অধিকারী

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:২৪
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র

আর মাত্র কিছু ক্ষণ পরেই আমি মারা যাব। সবুজ নীল গেরুয়া সাদা আর কালো— নানা রঙে ভরা এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আমার নিরালম্ব পাগলপারা মনটা আত্মা নাম নিয়ে উড়ে যাবে মহাকাশে। সেখানে ভেসে বেড়াবে, ভেসে বেড়াবে, ভেসে বেড়াবে অনন্তকাল, যত দিন না আমার আবার ডাক পড়ে কোনও আসর সাজানোয়। কী করে জানলাম আমার এই অদূর ভবিষ্যতের ঘটতে চলা গল্পটা? সেটা খুব সহজ, তবে এখন গুরুত্বপূর্ণ নয় আর। তা ছাড়া যা হবে তা নিয়ে লিখতে বসিনি। যা হলই না, শত চেষ্টাতেও শুধু সেইটুকুই শেষবারের মতো জানিয়ে যাব বলেই এত রাতে মাথা সোজা করে একটু লেখার চেষ্টা করছি, যদি কেউ এক মুহূর্তের জন্যও বুঝতে পারে আমার শেষ ইচ্ছেটা। বুঝতে পেরে একটা নিঃশ্বাসও যদি ছুড়ে দেয় আমার উড়ে যাওয়া তৃষ্ণার্ত প্রাণটার দিকে, আর সেই নিঃশ্বাসে যদি মিশে থাকে এক বিন্দু চোখের জল, তা হলেই আমার এই শেষ লেখাটা সার্থক হয়ে যাবে। তা ছাড়া সময়ও যে বড্ডই কম আমার হাতে, আর তো মাত্র কয়েক সেকেন্ড! রঙিন সাবানজলের মধ্যে ফুঁ দিয়ে বাবল তৈরি করে হাওয়ায় ছুড়ে দিয়েছি কত। তাতে সূর্যের আলো পড়ে রামধনু ভেসে ভেসে যেত চোখের উপরে। প্রেম হল সেই রামধনু, যার কয়েক সেকেন্ডের প্রাণ শুধু সেই সাবানজলের বুদ্বুদের মতো ক্ষণস্থায়ী, যাকে দেখতে দেখতে, বুকের ভিতর অনুভব করতে করতেই হারিয়ে যায়। শত মাথা কুটে মরলেও আর ফিরে আসে না। ভালবাসা আর প্রেম এক নয় কিন্তু। ভালবাসা আমি অনেক অনেক পেয়েছি জীবনে, লোহার দেওয়ালের মতো শক্ত কঠিন নিরেট ভালবাসা, কখনও নিশ্ছিদ্র নিপাট। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম সাত রঙের সমুদ্রে নিজেকে আমৃত্যু ডুবিয়ে রাখতে। পারলাম না। তাই এই যাওয়ার বেলায় কেমন ফ্যাকাশে আমার গায়ের চামড়া, নিরক্ত সারা শরীর। একটাই প্রশ্ন রেখে যাচ্ছি আগামী কোনও অনাগত জন্মের কাছে, রামধনু, ও রামধনু, তুমি চিরকালীন আমার হবে?’

Advertisement

চার পাঁচটা এ ফোর কাগজের পাতা, এক দিকে লেখা, আর এক দিকে সাদা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে ভুরু কুঁচকে সামনে দাঁড়ানো দক্ষিণী নার্সের দিকে তাকায় অভিরূপ। “হোয়াট রাবিশ আর দিস? আর নট ইউ প্রপারলি লুকিং আফটার হার রিতা?”

“ নো... নো স্যর...আই মিন...ইয়েস...”

Advertisement

“তা হলে এতখানি লেখার সুযোগ পেল কী করে? এতে তো উত্তেজনা বাড়বে। ডিনারের পর ঘুমের ওষুধ আছে, টাইমলি দিলে এতটা স্ট্রেন নেওয়ার সুযোগ হয় না। শি নিডস সাউন্ড স্লিপ টুনাইট,” গম্ভীর মুখে বলে অভিরূপ। ডাক্তার অভিরূপ মুখোপাধ্যায়। যার ধমক শুনে মাথা নিচু করে ফেলেছে নার্স রিতা আইয়ার। “সরি স্যর... আই’ল কিপ স্ট্রিক্ট ভিজিল।’’

“ঠিক আছে। কোনও দরকার হলে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে জানাবে। আশা করছি, কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু খেয়াল রাখবে। এই ভুল যাতে আর না হয়।”

কথা ক’টা বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল অভিরূপ। কী মনে করে পিছন ফিরে বিছানায় শোওয়া মানুষটার ফ্যাকাশে কপালটা, যার নীচে দুটো বোজা চোখ, এক বার হাত দিয়ে ছোঁয়। তার পর এ ফোর কাগজের লেখা পাতাগুলো রোল করে নিয়ে বেরিয়ে যায় কেবিন নম্বর ছ’শো তিন থেকে। শুশ্রূষা সুপারস্পেশ্যালটি হাসপাতালের কার্ডিয়োলজিস্ট ডাক্তার অভিরূপ মুখোপাধ্যায় জানতেই পারে না, তার ঘুমিয়ে থাকা অবাধ্য রোগিণীটির বোজা চোখের পাতা থেকে সাতরঙা হাসির ঢেঊ এসে ছিটকে যাচ্ছে পাতলা দুটি সুবঙ্কিম ঠোঁটের কিনারায়।

ছ’তলার লিফটে ঢুকে এক সেকেন্ড চোখ বুজে দাঁড়ায় অভিরূপ। একটু ক্লান্ত লাগছে। এখন রাত প্রায় আড়াইটে। বাড়ি পৌঁছে বিছানায় যেতে যেতে সাড়ে তিনটে বেজেই যাবে। আজ আর ঘুম হবে না বোধহয়। কিন্তু একটু চোখ না বুজলে কাল সমস্যা হবে। গত তিন দিন ধরে অতিরিক্ত প্রেশার যাচ্ছে। আজ সবে চোখের পাতা বুজে এসেছিল, আর ঠিক তখনই কল পেয়ে বেরিয়ে আসতে হল।

হুহু করে নেমে এল লিফট। ধীরে দরজা খুলে গেল। ইমার্জেন্সির পাশ দিয়ে শর্টকাট করতে যাবে, পিছন থেকে ডাকে নম্রতা। আজ রাতে ইমার্জেন্সি টিমে ডাক্তার নম্রতা বেরা আছে। কী করে যেন টের পেয়ে গিয়েছে, অভিরূপ যাচ্ছে করিডর দিয়ে। তাই একটু দাঁড়িয়ে ভদ্রতা না করে যেতে পারে না অভিরূপ। মুখে প্লাস্টিক হাসি আনতেই হয়।

নম্রতা হাসির গুণাগুণ বিচার করে না। অভিরূপ হেসেছে, ও তাতেই খুশি। প্রায় ঘাড়ের কাছে মুখ এনে বলে, “তোমার কাজ শেষ? একটু কফি খেয়ে গেলে হত না?’’

সন্তর্পণে সরে দাঁড়ায় অভিরূপ, “এখন থাক। বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। অনেক রাত হল। চলি... বাই।”

কথাটা বলেই পা বাড়িয়েছিল, কিন্তু পিছন থেকে নম্রতার কণ্ঠ থামিয়ে দেয়, “হাতে করে একগাদা কী কাগজ নিয়ে যাচ্ছ? পেশেন্ট হিস্ট্রি বুঝি? অ্যাটেন্ড্যান্ট কেউ নেই? গাড়িতে তুলে দিত?’’

হাতের রোল পাকানো কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু হাসে অভিরূপ, “ওহ! নো থ্যাঙ্কস। গেটিং লেট। বাই...’’

আর না দাঁড়িয়ে কাচের দরজা ঠেলে গাড়ির কাছে এসে থামে অভিরূপ। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্টার্ট করতে হবে। নইলে নম্রতা এখানেও চলে আসতে পারে! এ রকম অভিজ্ঞতা ওর আগেও হয়েছে। আর এই শুকনো ভদ্রতা করতে এত রাতে একটুও ভাল লাগছে না।

শুশ্রূষা-র বাউন্ডারি লাইন বরাবর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু গাছের সারিতে হলদে রঙের মার্কারি ভেপার লাইট পড়ে কেমন মায়াবী একটা পরিবেশ তৈরি করেছে। দিনের বেলায় এখানে হাজার লোকের আনাগোনা। আর এই মধ্যরাতে কেমন জনমানবহীন অতিপ্রাকৃত নির্জনতায় ভরে আছে চারপাশ। শুধু গেটের পাশে কুঁকড়ে বসে থাকা আধবুড়ো লোকটা বেহালায় ছড় টেনে টেনে ভেঙে দিতে চাইছে সেই নীরবতা। ওকে অনেক বার দেখেছে অভিরূপ। কেন যে এই গেটের সামনে বসেই ও সারা রাত বেহালা বাজায়, কেউ জানে না। অভিরূপের মনে হয় লোকটা পাগলও নয়, ভিখিরিও নয়। অন্য রকম মানুষ, যেন অন্য এক পৃথিবীর বাসিন্দা। সারা দিন ওকে দেখা যায় না। সন্ধেবেলায় কোত্থেকে এসে গেটের পাশে থামে ভর দিয়ে বসে। গাড়িটা খুব আস্তে ওর পাশ কাটিয়ে বার করার সময় এক ঝলক তাকিয়ে দেখে অভিরূপ, চোখ বুজে একমনে বেহালায় ছড় টেনে যাচ্ছে। কে এল বা গেল কোনও দিকে ওর নজর নেই।

লোকটার কথা ভাবতে ভাবতেই কখন গাড়ি উঠেছে বড় রাস্তায়। ওই বোজা চোখ দুটো দেখে অভিরূপের মনে ভেসে ওঠে ছ’শো তিন কেবিনের চোখ বোজা পেশেন্টের কথা। তার পরেই নম্রতার প্রশ্ন। সত্যিই তো, এগুলো আমি কেন বয়ে নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে করে? পেশেন্টের কেস হিস্ট্রি? এই কাগজগুলোয় যা লেখা আছে তার সঙ্গে আমার তো কোনও সম্পর্ক নেই, তা হলে কী হবে এই অনর্থক বোঝা বয়ে? তার চেয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে যাই রাতের রাজপথে। কিছু অর্থহীন প্রলাপ মিশে যাক অন্ধকারের মধ্যে। এক দিক দিয়ে ফেলার কথা ভাবে, অন্য দিকে কেউ তারস্বরে না না করে উঠে বাধা দেয়। কী যেন সব কথা লেখা আছে না? কী সব রামধনু-টামধনু? আরও এক বার পড়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। হাল্কা হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রাস্তার মাঝখানে শোওয়া একটা ঘুমন্ত কুকুরকে জীবন দান দিতে দিতে একাই হেসে ফেলে অভিরূপ। ওর নিজের যে ইচ্ছে বলে কোনও কিছু এখনও বেঁচে আছে মনের মধ্যে সেটা সহসা জানতে পেরে বেশ একটা আনন্দানুভূতি থেকেই এই হাসি। না, মহিলার মধ্যে কিছু একটা আছে এ কথা মানতেই হবে। মাত্র তিন দিন তো দেখেছে ওই কালো কালো ছটফটে দুরন্ত চোখদুটো, মাত্র তিন দিন শুনেছে ওর রিনরিনে গলার কিছু অনর্গল কথা। মাত্র তিন দিন ওই নদীর পাড়ভাঙা হাসির টুকরো টুকরো ঢেউ গুনেছে ওর অনাবিল গাম্ভীর্যের বন্ধ দরজার এ পার থেকে। এটুকুতেই ওর মতো কাঠখোট্টা কাজসর্বস্ব এক মানুষের ইচ্ছে জাগল ওই প্রলাপ ভরা কাগজগুলো আরও এক বার পড়ে দেখবার! এই রকম পেশেন্ট যত তাড়াতাড়ি ছুটি পেয়ে চলে যায় ততই মঙ্গল।

গাড়িটা গ্যারাজ করে ঘরে ঢোকে অভিরূপ। নীল আলোর নীচে সাদা বিছানায় পা দুটো ভাঁজ করে পিছন ফিরে শুয়ে আছে চুমকি। নিজের বালিশটা উল্টো ধারে নিয়ে এসে রিডিং ল্যাম্পটা সবে জ্বেলেছে, চোখের উপর মেলে ধরেছে সাদা কাগজের রোল, ঠিক এমন সময় তীব্র গলায় বেজে ওঠে চুমকি, “অপারেশন সাকসেসফুল?”

অভিরূপ ভাবেনি চুমকি জেগে থাকতে পারে। কোনও দিনই তো থাকে না। বেশ খানিকটা চমকে বলে, “হ্যাঁ। ঘুমোচ্ছে। কাল রিলিজ় করে দেব।”

“স্ট্রেঞ্জ! এত সিরিয়াস পেশেন্ট... এত রাতে ছুটে যেতে হল, সে কালই রিলিজ় হবে? এদের সাত-দশ দিন ধরে রাখলে তবেই না বিল ইনক্রিজ় হবে!” কোলবালিশ টেনে নিয়ে নড়েচড়ে বলে চুমকি, “যাকগে যাক, তোমার পাঁঠা তুমি ল্যাজে কাটো আর মাথায় কাটো, আমার কী? লাইটটা নিভিয়ে দাও। মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থাকা রোজ রোজ। মহাপাপ করেছিলাম, তাই ডাক্তারের বৌ হয়েছি। বিরক্তিকর!’’

উত্তরটা দিয়েই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল অভিরূপ। যে পেশেন্টের জন্য কল পেয়ে গিয়েছিল তার অবস্থা সত্যিই ভয়ঙ্কর ছিল। প্রায় একশো শতাংশ ব্লক নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল। দুটো স্টেন্ট বসেছে। আজকের রাতটা তাকে সিসিইউ-তে রেখে এসেছে। আশা করা যায় বিপদ কেটে গিয়েছে। এখন শুধু অবজ়ার্ভেশন। কিন্তু চুমকির প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে যার কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, সে তো অন্য কেউ। সে কাল রিলিজ় হয়ে যাবে। সে সেই পেশেন্ট যার কাছে জোর করে নিজেকে মুখোশ পরিয়ে রাখতে হয়। না হলে এত দিনের চেষ্টায় গড়া ইমারত ভেঙে যাতে পারত।

আমিও কি ওই মহিলার মতোই অনাবশ্যক ভাবনাচিন্তা শুরু করলাম? ওর কথা ভেবে একটা ভুল উত্তর দিয়ে বসলাম? না, এই অহেতুক চিন্তার দুর্বলতা আমাকে মানায় না। নিজের উপর বেশ খানিকটা বিরক্ত হয়েই সাইড টেবিলের ড্রয়ার টেনে কাগজগুলো রেখে দেয় অভিরূপ। যেন নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টায় শব্দ করেই নিভিয়ে দেয় রিডিং লাইট।

এ বার ঘুমের জন্য সকরুণ প্রার্থনা। কিন্তু ঘুম তো আসে না। বোজা চোখের পাতায় আলতো পা ফেলে ভেসে যায় আকাশি নীল সালোয়ার-কামিজ পরা মেঘলা রঙের মেয়ে। লোহার তৈরি হৃদয়ের ধার দিয়ে কেমন একটু ভিন্ন রকম অনুভূতি ছুঁয়ে যায় অভিরূপকে। অদ্ভুত এই চাওয়া। কিন্তু আমি কেন অনাবশ্যক ভেবে যাচ্ছি এই নিতান্ত স্বল্প চেনা একটি পেশেন্ট নিয়ে! আজ বাদে কাল চলে যাবে, ব্যস ফুরিয়ে গেল সম্পর্ক। শুধু শুধু কেন মাথায় ডাম্প করছি! এ সব মানায় না আমাকে। ঘুম চাই ঘুম, চিন্তাহীন ঘুম। নিজের চেতনাকে বকুনি দিয়ে ধমকে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লেও, ডাক্তার অভিরূপ মুখোপাধ্যায় নিজের মনকে শাসনে বাঁধতে পারে না। সেখানে থেকে থেকেই ঢুকে পড়ছে দ্য লাইফ ডেলি-র রিপোর্টার তিয়াষা মিত্র।

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement