ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: নবনী কমলেশকে বললেন, আহিরীর জন্য একটা ভাল সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। দেশে এসেছিল, আহিরীর সঙ্গে আলাপও হয়েছে। কমলেশ জানতেন না, অবাক হলেন। নবনী বললেন, রাত বারোটা বাজতে চলল, তিনি এক্ষুনি আহিরীর কলেজে যাবেন কী হচ্ছে দেখতে। কমলেশ বিভূতিকে ফোন করলেন।
খুশি হলেন কমলেশ। এই সময়টুকুর মধ্যেই বিভূতি সিকিয়োরিটির সঙ্গে আলাপ করে ফেলেছে। চটপটে লোক। বছরখানেক আগে এর সন্ধান পেয়েছিলেন কমলেশ। এক দিন অফিসে কাজ করছেন, নিলয় ফোন করে বলল, ‘‘স্যর, এক জন দেখা করতে চাইছে। রিসেপশনে বসে আছে।’’
কমলেশ বিরক্ত গলায় বললেন, ‘‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?’’
নিলয় বলল, ‘‘না স্যর।’’
কমলেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘‘তা হলে আমাকে জানাচ্ছ কেন? অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করার মতো সময় কি আমার থাকে নিলয়?’’
নিলয় আমতা আমতা করে বলেছিল, ‘‘স্যর, লোকটা বলছে ওর কাছে নাকি জরুরি খবর আছে।’’
কমলেশ আরও বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘‘কী খবর?’’
‘‘বলছে আপনাকে ছাড়া বলা যাবে না।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘ওকে বলে দাও, আমার কোনও জরুরি খবরের প্রয়োজন নেই।’’
রিসিভার নামাতে গেলে নিলয় প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘‘স্যর, লোকটা বলেছে প্রোডাকশন ম্যানেজার আদিত্য সাহা সম্পর্কে সিক্রেট কিছু...’’
কমলেশ বহু দিন পরে অফিসে চিৎকার করে উঠেছিলেন।
‘‘গেটে গার্ড কেউ নেই? ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও। এত বড় স্পর্ধা!’’
এই ঘটনার ঠিক এক মাস পরে আদিত্য সাহা কোম্পানি ছেড়ে চলে যায়। কিছু দিনের মধ্যে জানা যায়, কোম্পানির নাম করে সে বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু টাকা নিয়েছে। সব থেকে খারাপ যেটা করেছে তা হল, কোম্পানি যেখানে যেখানে অর্ডার সাপ্লাই করে, সেখান থেকে অ্যাডভান্সও নিয়েছে। পুলিশে কমপ্লেন করার মতো কোনও প্রমাণ সে রেখে যায়নি। একমাত্র উপায় ছিল আগে খবর পেয়ে হাতেনাতে ধরা।
এই ঘটনার দেড় মাস পরে অচেনা নম্বর থেকে ফোন পেলেন কমলেশ।
‘‘কে বলছেন?’
উলটো দিকের গলা অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘‘আমি বিভূতি। বিভূতি বসাক। সবাই সংক্ষেপে বি. বি. ডাকে। আপনার কাছে গিয়েছিলাম স্যর, ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। আপনার ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করছি বলে অপরাধ নেবেন না।’’
কমলেশ রায় ‘জেন্টলম্যান’ হিসেবে পরিচিত। চট করে খারাপ ব্যবহার তার ধাতে নেই। তিনি ঠান্ডা গলাতেই বললেন, ‘‘আপনার কী চাই?’’
‘‘কিছু চাই না স্যর।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘কিছু চাই না তো ফোন করেছেন কেন? এই সময় তো আমি কারও সঙ্গে গল্প করি না।’’
বিভূতি গদগদ গলায় বলল, ‘‘আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না স্যর। বয়সে ছোট, অতি সামান্য মানুষ।’’
এ বার রাগ হল কমলেশের। চড়া গলায় বললেন, ‘‘কাজের কথা বলুন। আমি ব্যস্ত আছি।’’
ফোনের ও পাশে বিভূতি নামের লোকটা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘‘স্যর, কিছু দিন আগে আমি আপনাকে আপনাদের প্রোডাকশন ম্যানেজারের খবরটা দিতে চেয়েছিলাম। আপনি তো শুনলেনই না।’’ লোকটা একটু থামল। তার পর বলল, ‘‘শুনলে এতটা ক্ষতি হত না। টাকার থেকে আপনাদের গুডউইলের ক্ষতি হয়েছে বেশি।’’
এ বার থমকেছিলেন কমলেশ। শান্ত ভাবে বললেন, ‘‘আপনি কি আদিত্য সাহার শত্রু?’’
ও পাশে হালকা হাসির আওয়াজ হল।
‘‘স্যর, আমি কারও শত্রু বা বন্ধু নই। আমি খবর জোগাড় করি। আদিত্য সাহার খবর পাওয়ার পর লেগে থাকি। খবর পাকা হওয়ার পরেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। ফর ওয়ান রিজন স্যর। যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়।’’
কমলেশ রায় বললেন, ‘‘স্পাই?’’
‘‘অনেকটা তাই স্যর। এক সময় পুলিশেও কাজ করেছি। তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে খেলতাম। এখন প্রাইভেটে কাজ করি। ভাবলাম বড় কোম্পানিতে যদি কিছু কাজ পাই। অনেক সময় আপনাদেরও তো গোপন খবর লাগে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘সরি বিভূতিবাবু, আমাদের কোনও গোপন খবর লাগে না।’’
কথা শেষ করে ফোন কেটে দিয়েছিলেন কমলেশ। এর এক ঘণ্টা পরে কল লিস্টের নম্বর সার্চ করে লোকটিকে ডেকে নেন কমলেশ। অফিসে না, অফিস থেকে সামান্য দূরে এক কফি শপে ডেকে নেন। চকচকে কফি শপের জন্য এই লোক একেবারেই বেমানান। মাঝবয়সি, ছাপোষা চেহারা। ভিড়ে আলাদা করবার কোনও উপায় নেই। একেবারে ‘চর’ যেমনটি হওয়া উচিত। কমলেশ বলেছিলেন, ‘‘কোম্পানি নয়, আপনি আমার হয়ে কাজ করবেন। রাজি আছেন?’’
বিভূতি বলল, ‘‘টাকাপয়সা ঠিক মতো পেলে রাজি না হওয়ার কোনও কারণ নেই স্যর।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘আমার জন্য জোগাড় করা ইনফরমেশন যে আপনি অন্য কাউকে দিয়ে দেবেন না সে গ্যারান্টি কী? আপনাকে বিশ্বাস করব কেন?’’
বিভূতি কফি নয়, খাবার দিতে বলেছিল। খাওয়ার ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়, খিদে আছে। যত্ন করে কেকে কামড় দিয়ে বলল, ‘‘কোনও গ্যারান্টি নেই। আপনাদের প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাছ থেকে তো অনেক গ্যারান্টি পেয়েছিলেন। কী লাভ হল? ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে স্যর, গ্যারান্টি, কন্ডিশন, বিশ্বাস— এ সব নিয়ে কাজ না করাই ভাল। এ সব ধারণা আজকের দিনে ফালতু।’’
কমলেশ খুশি হলেন। এই লোক ঠগ, জালিয়াত হলেও স্পষ্ট কথার মানুষ। বিভূতিকে তিনি মাসকাবারি ব্যবস্থায় রেখেছেন। মাসে মাসে টাকা দেন। দরকার হলে যোগাযোগ করেন। আর কেউ জানে না। তথ্য সংগ্রহের এই প্যারালাল সিস্টেম তার একান্তই নিজের। ইতিমধ্যে সে কয়েকটা ছুটকো-ছাটকা কাজ করেছে। তার মধ্যে একটা জরুরি কাজ। প্রাইভেট সেক্রেটারি নিলয় সম্পর্কে ইনফরমেশন। নিলয় একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে। প্রেম করাটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়। খবর হল, যে মেয়েটির সঙ্গে নিলয় প্রেম করেছে সে এমন একটি সংস্থার কর্মী যারা সম্প্রতি কোম্পানির প্রোডাক্ট প্রোমোশন এবং ব্র্যান্ডিং-এর দায়িত্ব পেয়েছে। এর পিছনে কি নিলয়ের কোনও ইনফ্লুয়েন্স আছে?
বিভূতিকে আজ কমলেশ নিজের কাজে লাগিয়েছেন। আহিরী কলেজ থেকে ফোন করে ঘেরাওয়ের খবর জানানোর কিছু পরে, বিভূতিকে ফোন করেছিলেন।
‘‘কী খবর চাই স্যর?’’
এই ক’দিনে বিভূতির সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হয়েছে। ভাল ম্যানেজার হতে গেলে গুপ্তচর পুষতে হবে, এমন কথা ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার সিলেবাসে নেই। দেশ-বিদেশ কোথাও নেই। তার ওপর কাজটা ‘পারফেক্ট জেন্টলম্যান’-এর মতো নয়। বরং খানিকটা ‘নীচে নেমে যাওয়া’ই বলা যায়। কমলেশ রায়ের ইমেজের সঙ্গে যায় না। তার পরেও কমলেশের মনে হয়েছে, এটা জরুরি। গোপন তথ্য কোনও কোনও সময়ে মানুষ চিনতে সাহায্য করে। এই তথ্য হাতে থাকলে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হয়। সিদ্ধাম্ত না নিতে পারলেও সুবিধে হয়। ইমেজ নিয়ে বসে থাকা যায়, কাজ করতে গেলে রিয়েলিটির প্রয়োজন। এক জন দক্ষ প্রফেশনাল নিজের মতো করে তার বাস্তব প্রয়োজন মেটায়। বিভূতিকে নিয়োগ করা অনেকটা সে রকমই। এর মধ্যে ন্যায়-অন্যায়ের কিছু নেই। ইনফরমেশনে ভরা এই দুনিয়াতে আরও একটি প্রক্রিয়ায় ইনফরমেশন আয়ত্তে আনবার চেষ্টা।
কমলেশ আজ বিভূতিকে বলেছিলেন, ‘‘খবর কিছু চাই না। তুমি সিচুয়েশনের ওপর নজর রাখবে। মাঝেমধ্যে আমাকে আপডেট দেবে।’’
ইতিমধ্যে বার কয়েক সে ফোনে খবরও পাঠিয়েছে। জানিয়েছে, পুলিশ এসেছে, কিন্তু কলেজের ভিতর ঢোকেনি।
‘‘স্যর, আমি কি ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করব? আপনার মেয়ে কেমন আছেন যদি জানতে পারি!’’
কমলেশ তাড়াতাড়ি বললেন, ‘‘খবরদার না। তুমি বাইরে থাকো। কোনও ডেভেলপমেন্ট হলে জানিয়ো।’’
কমলেশ উঠে পড়লেন। নবনীকে শান্ত করা দরকার। সত্যি সত্যি সে যদি মেয়ের কলেজে যাওয়ার চেষ্টা করে, সেটা একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হবে।
• ৭ •
আহিরী কলেজের দোতলায়। শর্মিষ্ঠা দত্তর ঘরের বাইরে চেয়ারে বসে আছে। চারপাশে ভাঙা কাচ, ভাঙা টবের টুকরো ছড়ানো। এগুলো পরিষ্কার করার জন্য লোক এসেছিল। শর্মিষ্ঠা দত্ত বারণ করেন। তখন তিনি রাগে আগুন হয়ে ছিলেন। দঁাত কিড়মিড় করে বলেছিলেন, ‘‘টিভি থেকে লোক আসছে। তারা এই সব ভাঙচুরের ছবি তুলবে। তখন ঠেলা বুঝতে পারবে ওরা।’’
টিভির লোক ছবি তুলে নিয়ে গেছে। সেই ছবি দেখানোও হয়েছে। কেউ কোনও ‘ঠেলা’ বোঝেনি। ছেলেমেয়েরা ঘেরাও থেকে সরেনি।
আহিরীর ক্লান্ত লাগছে। খাওয়াদাওয়া কিছু হয়নি। চা-ও নয়। ছেলেরা টিচার্স রুমে চা এনেছিল। কেটলি-ভর্তি চা, কাগজের কাপ, বিস্কুট নিয়ে ঢুকেছিল। সবাই ভদ্র ভাবে তা প্রত্যাখান করে। যারা জোর করে আটকে রেখেেছ, তাদের দেওয়া চা খাওয়া যায় না। যদিও আহিরীর খুব ইচ্ছে করছিল।
ঘেরাও হয়ে থাকতে যতটা খারাপ লাগছে, আহিরীর তার থেকেও বেশি অসহ্য লাগছে টিচার্স রুমে ঠায় বসে থাকা। সকলেরই কিছু না কিছু মত রয়েছে। কারও রাগ অর্কপ্রভ সেনের ওপর। তারা বলছে, ওঁর জন্যই যত ঝামেলা। সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। করলেও তা পরে ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল। অমন দুচ্ছাই করে তাড়িয়ে দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হয়। আবার কেউ বলেছে, ছেলেমেয়েরা অতি বদ। সব গোল্লায় গেছে। পরীক্ষার সময় পড়াশোনা করেনি বলে ঝামেলা পাকিয়েছে। ইস্যুটাকে কায়দা করে কলেজের দুর্নীতির দিকে নিয়ে গেছে। যাতে কেউ নিন্দে করতে না পারে। আবার কারও মত, এর পিছনে বড় মাথা আছে। কলেজে ঝামেলা পাকানোর জন্য ফঁাক-ফোকর খঁুজছিল। মহিলারা সকলেই টেনশন করছেন। স্বাভাবিক। ঘর-সংসার আছে। এর মধ্যে দু-এক জন তো আহিরীকে বলেই বসল, ‘‘খুব বঁাচান বেঁচে গেছ। এই যদি বিয়ে-থা করে ছেলেমেয়ের মা হতে, দেখতে ঝামেলা কাকে বলে।’’
আহিরীর বলতে ইচ্ছে করল, ‘‘ঠিকই বলেছেন। এখন আমি দিনের পর দিন নিশ্চিন্তে ঘেরাও হয়ে থাকতে পারব। মাসখানেকও বসে থাকতে পারি।’’
কিন্তু সে কথা তো আর বলা যায় না। এ রকম একটা জটিল সময়ে কেউ রসিকতা নিতে পারবে না।
ক্রমশ