ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।
আটটার পর থেকে পুরুষরাও অধৈর্য হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষণ ‘কিছু নয়’ ভান করেছিল, আর পারছে না। মুখে বলছে ইস, অনেক লেখাপড়া করার ছিল। আসলে শুগার, প্রেশারের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কারও কারও আবার ঠিক সময়ে পারগেটিভস্ না খেলে পর দিন সমস্যা। নিশ্চিন্ত জীবনে আকাশ থেকে ঝপ করে ঝামেলা এসে পড়েছে।
আহিরী কোনও আলোচনাতেই নেই। ‘হু-হ্যাঁ’-এর বেশি সে অংশগ্রহণও করছে না। বেশির ভাগ সময়টাই ঘরের বাইরে বারান্দায় পায়চারি করেছে। এর মধ্যে পরীক্ষা-হলের সেই টুকলি করা মেয়েটা— উর্বী— এসেছিল।
‘‘ম্যাডাম, আমার মোবাইলটা প্লিজ দিয়ে দিন। বাড়িতে খবর দিতে পারছি না।’’
আহিরী বলল, ‘‘তুমি বাড়ি যাওনি? এত রাত পর্যন্ত কলেজে কী করছ?’’
উর্বী মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলল, ‘‘ওদের সঙ্গে আছি।’’
আহিরী বলল, ‘‘আমাদের যারা ঘেরাও করে রেখেছে ওদের সঙ্গে?’’
উর্বী কিছু বলল না। মাথা নামিয়ে দঁাড়িয়ে রইল। আহিরী মেয়েটির দিকে এ বার ভাল করে তাকাল। দেখতে-শুনতে ভাল। সাজপোশাক চটকদার। সালোয়ার কামিজটা বেশ ফ্যাশনদুরস্ত। মজার কথা, সেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কলেজে পড়ে আছে, কিন্তু চোখেমুখে কোনও ক্লান্তির ভাব নেই। তার মানে এর সঙ্গে মেক-আপ কিট আছে। সুযোগ পেলেই আড়ালে গিয়ে পাফ করে নিচ্ছে।
আহিরী বলল, ‘‘তুমি অফিসে গিয়ে আমার নাম করে বলো। আচ্ছা, এসো আমার সঙ্গে।’’
মোবাইল হাতে নিয়ে উর্বী বলল, ‘‘ম্যাডাম, আর কখনও হবে না।’’
আহিরী বলল, ‘‘আমাকে বলতে হবে না। নিজেকে বলো। তোমার বাড়ি কোথায়?’’
‘‘কঁাকুড়গাছি।’’
আহিরী বলল, ‘‘বাবা, সে তো এখান থেকে অনেকটা দূর। ফিরবে কী করে?’’
উর্বী হাসিমুখে বলল, ‘‘বাস পাব তো। না
পেলে সিনিয়র দাদারা কেউ পৌঁছে দেবে। ওদের বাইক আছে।’’
আহিরী বুঝতে পারল, এই মেয়ে চাইছে তার দেরি হোক এবং ‘সিনিয়র দাদা’রা কেউ পৌঁছে দিক।
আহিরীর মোবাইলে অনেক ক্ষণ আগেই চার্জ ফুরিয়েছে। পাওয়ার ব্যাঙ্ক গাড়িতে বলে সমস্যা হচ্ছে। গিয়ে নিয়ে আসতে পারে, ছেলেমেয়েরা কিছু বলবে না। কিন্তু সে এই সুযোগ নেবে না। মোবাইল অফ করে রেখেছে। এক দিক থেকে ভাল হয়েছে। মা বড্ড জ্বালাতন করছে। যত দিন যাচ্ছে মায়ের সমস্যা বাড়ছে। খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। এক বার থাইরয়েডটা চেক করানো উচিত। গাইনোকোলজির সমস্যাও হতে পারে। মা’কে কে এ সব বলবে? বাবার সঙ্গেও সম্পর্কটা কেমন যেন হয়ে গেছে। কোথাও একটা তাল কাটছে। বেশ কয়েক বছর ধরে এটা চলছে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। কিছু কি ঘটেছে? বুড়ো বয়েসে আর কী ঘটবে? বাবা নিশ্চয়ই প্রেমে পড়েনি। পড়তেও পারে। প্রেমের সঙ্গে বয়সের কী সম্পর্ক? কিঙ্কিণীর বাবা তো সিক্সটি ছুঁই-ছঁুইতে বিয়ে করল। মেয়েটি নাকি মেরেকেটে ছাব্বিশ। কিঙ্কিণী আহিরীর ইউনিভার্সিটির ব্যাচমেট। এখন বিদেশে রিসার্চ করছে। খুব ছোটবেলায় মা ক্যানসারে মারা যায়। বাবা-ই মেয়েকে মানুষ করেছে। এমনি মানুষ-করা নয়, পাখির ছানার মতো আগলে মানু্ষ করা। সে দিন ফেসবুকে কিঙ্কিণীর সঙ্গে কথা হল। সে বলল, ‘‘বাবা নতুন জীবন শুরু করছে।’’
আহিরী লিখল, ‘‘সেটা কী রকম? নিউ জব?’’
কিঙ্কিণী লিখল, ‘‘না। বাবা বিয়ে করেছে।’’
আহিরী লিখল, ‘‘তাই নাকি!’’
কিঙ্কিণী লিখল, ‘‘মেয়েটি আমার থেকে একটু ছোট। সেও বাবার মতোই এক জন আর্টিস্ট। তবে ড্রয়িং নয়, স্কাল্পচার করে। কাঠের কাজে নাকি কলকাতায় নাম করেছে। বাবার সঙ্গে দু’বছরের রিলেশন। বিয়ের আগে বাবা আমার কাছে পারমিশন চেয়েছিল।’’
আহিরী লিখল, ‘‘তুই নিশ্চয়ই হ্যাঁ বলেছিলি!’’
‘‘অবশ্যই বলেছি। বাকি জীবন মানুষটা এক জন সঙ্গী পাবে, এতে আমি সবচেয়ে খুশি। দে আর অলসো ভেরি হ্যাপি। এই সামারে আমার এখানে দু’জনে আসছে।’’
আহিরী লিখল, ‘‘মেসোমশাইকে আমার হয়ে কনগ্র্যাচুলেশনস জানাস।’’
কিঙ্কিণী একটা স্মাইলি দিয়ে লিখল, ‘‘আমার নতুন মা আমাকে বলেছে, নাম ধরে ডাকলে বেশি খুশি হবে। আমি ভেবেছি তা-ই করব। আমার বাবাকে যে ভালবাসে সে আমার বন্ধু। কি, ভুল ভেবেছি?’’
আহিরী লিখল, ‘‘একেবারেই নয়।’’
কিঙ্কিণীর বাবা যদি বিয়ে করে ফেলতে পারে, তা হলে তার বাবার প্রেমে পড়তে দোষ কী?
খানিক আগে বিতানকে ফোনে ধরেছিল। এই ছেলের সব কিছুতেই রসিকতা।
‘‘এখনও বন্দি? সাধে কি বলি, বেশি লেখাপড়া করা মানেই ঝামেলায় পড়া। টিচার ঘেরাও হচ্ছে, ডাক্তার মার খাচ্ছে, ব্রিজ ভাঙলে ইঞ্জিনিয়ার অ্যারেস্ট হচ্ছে, আইপিএস অফিসার হলে নেতা দাবড়াচ্ছে। আমি কত নিশ্চিন্ত, দেখো।’’
আহিরী বলল, ‘‘আমরা মোটেই বন্দি নই। খানিক আগে স্টুডেন্টরা এসে বলল, আমরা বাড়ি চলে যেতে পারি। শুধু টিটার-ইন-চার্জ আর অর্কপ্রভ সেনকে ওরা ছাড়বে না। আমরা রাজি হইনি। এটা তো মানা যায় না। যদিও ওই দু’জনেই পাজি।’’
বিতান বলল, ‘‘ও, তা হলে তোমরা এখন স্বেচ্ছাবন্দি?’’
‘‘মনে হচ্ছে, ছাড়া পাব। মিটিং চলছে।’’
বিতান বলল, ‘‘বাড়ি ফিরবে কী ভাবে?’
আহিরী বলল, ‘‘হেঁটে। এখন ছাড়ছি। মোবাইলে চার্জ প্রায় শেষ।’’
বিতান বলল, ‘‘ছাড়া পেলে জানিয়ো।’’
খানিক আগে শর্মিষ্ঠা দত্ত আহিরীকে ঘরে ডেকে পাঠান। নরম গলায় বলেন, ‘‘তুমি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলো। বলো, ঘেরাও তুলে নিতে।’’
আহিরী আকাশ থেকে পড়ে, ‘‘আমি বলব! আমার কথা ওরা শুনবে কেন?’’
চওড়া টেবিলের এক দিকে বসে আছেন অর্কপ্রভ সেন। তিনি বললেন, ‘‘তুমি বললে ওরা শুনবে। তোমাকে ওরা পছন্দ করে।’’
আহিরী অবাক হয়ে দেখল, যে মানুষটা কথা বন্ধ করে দিয়েছিল, সে শুধু তার সঙ্গে এখন কথাই বলছে না, মনে হচ্ছে কথা বলার আগে এক কাপ মধুও গিলে নিয়েছে।
আহিরী বলল, ‘‘স্যর, আমাকে কেউ কেউ পছন্দ করে ঠিকই, কিন্তু আমি এ সব পলিটিক্সের মধ্যে কখনও থাকি না। থাকবও না। তা ছাড়া, আমি এক জন জুনিয়র টিচার। আমার কথা ছেলেমেয়েরা শুনবে কেন?’’
টিচার-ইন-চার্জ বললেন, ‘‘তোমায় থাকতে হবে না। তুমি শুধু একটা অ্যাপিল করো। এতগুলো বয়স্ক মানুষ আটকে রয়েছেন। কেউ অসুস্থ
হয়ে পড়লে...’’
আহিরীরা টিচার্স রুমে বসেই খবর পেয়েছিল, শর্মিষ্ঠা দত্ত বাইরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বলে দিয়েছে, ছাত্রদের ব্যাপারে জোরজুলুম করা সম্ভব নয়। আলোচনা করে মিটিয়ে নিতে হবে। অর্কপ্রভ সেন সরকারের কোনও হর্তাকর্তাকে ধরেছিলেন। তিনি নাকি আর এক কাঠি ওপরে গিয়েছেন। বলেছেন, এই কলেজের টাকাপয়সা নিয়ে কমপ্লেন আছে। এখানে হাত দেওয়া যাবে না। যে কোনও সময় ইনভেস্টিগেশনের অর্ডার হয়ে যেতে পারে। এই সময় আগ বাড়িয়ে কলেজের পক্ষ নিয়ে কিছু করতে যাওয়া সম্ভব নয়। এতে শর্মিষ্ঠা দত্তরা খুবই ঘাবড়েছেন। অনেক জনকে হাতড়ে এখন আহিরীকেই ভরসা হয়েছে। নিশ্চয়ই অকর্প্রভ সেন মাথায় ঢুকিয়েছেন।
আহিরী বলল, ‘‘ম্যাডাম, আমি ঘেরাও তুলে নিতে বলতে পারব না। আপনাদের সঙ্গে আলোচনায় যাতে বসে, তার জন্য অনুরোধ করতে পারি। তবে মনে হয় না শুনবে।’’
অর্কপ্রভ সেন টিচার-ইন-চার্জের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বললেন, ‘‘অন্তত তাই হোক। দরকার হলে দু–একটা ছোটখাটো ডিমান্ড মানতে হবে। তুমি কথা বলে দেখো আহিরী।’’
ছেলেমেয়েরা আহিরীর কথা শুনেছে। তারা মিটিঙে বসেছে। তাকে ভিতরের আলোচনায় ডাকা হয়েছিল। সে রাজি হয়নি। টিচার-ইন-চার্জ যেমন বলেছিলেন, ছাত্রছাত্রীরাও ডেকেছিল। এমনকী অর্কপ্রভ সেনও বলেছিলেন। আহিরী রাজি হয়নি। এই মিটিঙে বসবার সে কে? এরা প্রয়োজনে তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। তার বেশি নয়।
আহিরী শর্মিষ্ঠা দত্তর ঘরের সামনে থেকে সরে এল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে হল, যত রাতই হোক, বিতানকে আসতে বললে হত। গাড়ির পাশে বসে বাড়ি পর্যন্ত বকবক করতে করতে যেত। তার পর একটা ট্যাক্সি ধরে ফিরে যেত নাহয়। এখন যতই বকবক করুক, বিতানের সঙ্গে পরিচয় কিন্তু ঠিক উলটো কারণে। তার কম কথা এবং নিস্পৃহতা আহিরীকে প্রথম আকর্ষণ করেছিল।
সেটা ছিল এক ডিসেম্বরের বিকেল। কল্যাণী ইউনিভার্সিটিতে একটা সেমিনার সেরে কলকাতায় ফিরছিল আহিরী। কলেজে সবে জয়েন করেছে। তখনও তার নিজের গাড়ি হয়নি। অর্ডার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু রঙের জন্য পেতে সময় লাগছিল। আহিরী তখন সুযোগ পেলে বাবার গাড়ি নিয়ে বেরোয়। সে দিনও তা-ই করল। বাবা বলেছিল, ‘‘দীনেশকে নিয়ে যা।’’
আহিরী ভুরু কঁুচকে বলেছিল, ‘‘কেন? আমি গাড়ি চালাতে পারি না? দু’জন ড্রাইভারের কী প্রয়োজন?’’
বাবা হেসে বলেছিল, ‘‘তা অবশ্য ঠিক। এইটুকু পথ যেতে এক জনই এনাফ। তাও বলছিলাম, পথেঘাটে যদি কোনও সমস্যা হয়।’’
আহিরী কঁাধ ঝঁাকিয়ে বলল, ‘‘হলে হবে। দীনেশকাকা কি আমার সেভিয়ার? প্রবলেম হলে আমি ফেস করব। সারা পৃথিবীতে মেয়েরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ড্রাইভ করে চলে যাচ্ছে। আমাদের বেলায় এই আতুপাতুপনাটা এ বার ছাড়ো।’’
বাবা বললেন, ‘‘আই এগ্রি উইথ ইউ। তোমার মা’কে কিছু বোলো না। আর আমাকে অফিসে ড্রপ করে দিয়ে যাও।’’
কল্যাণী যাওয়ার রাস্তাটা চমৎকার। হাইওয়েতে ড্রাইভ করবার মজা আহিরীকে সব সময়েই টানে। হুহু করে পৌঁছে গেল। সেমিনার শেষ হতে হতে বিকেল। দু-এক জন আহিরীর সঙ্গে গাড়িতে ফেরার জন্য ছোঁক-ছোঁক করছিল। একেবারেই অচেনা। সেমিনারে আলাপ হয়েছে। আহিরী তাদের সহজ ভাবে কাটিয়ে দিল। তার নাকি কল্যাণীতে এক আত্মীয়ের বাড়ি যেতে হবে। তারা সাধাসাধি করলে রাতে বাড়ি ফেরা নাও হতে পারে। শেষে বলল, ‘‘ইস একসঙ্গে গেলে খুব ভাল হত। গল্প করা যেত। আশা করি পরে কখনও আমরা এই সুযোগ পাব।’’
ক্রমশ