ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
নবনী আঁতকে উঠে বলেছিলেন, ‘‘কী বলছিস!’’ আহিরী মা’কে ছেড়ে দিয়ে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ে বলল, ‘‘ঠিকই বলছি। ইন্টারভিউতে প্রশ্ন ছিল খুবই সহজ। একটা পাজল। পাজলটা হল— পাহাড়ি পথের ধারে, বলো দেখি কে অপেক্ষা করে? মোট কুড়িটা ছেলে উত্তর দিয়েছে। কেউ বলেছে ফুল, কেউ বলেছে ঝরনা, কেউ বলেছে কুয়াশা, কেউ বলেছে প্রেমিকা। সব ক্যানসেল। মাত্র দু’জনের জবাব আমাদের মনে ধরছে। তাদের আমরা নিয়েছি। এরা কে কী বলেছে জানতে চাও?’’
নবনী বিস্ফারিত চোখে বলেন, ‘‘তুই ছেলেদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছিস!’’
আহিরী মুচকি হেসে বলে, ‘‘শুধু তাই নয়, টেন্টেও আমরা ভাগাভাগি করে থাকব। ওনলি ফর লেডিজ বলে কিছু থাকবে না। পাহাড়ে নারী পুরুষে ভাগাভাগি করা যায় না। প্রকৃতি জেন্ডার ডিভিশন পছন্দ করে না।’’
সে দিন আর কথা বাড়াননি নবনী। এই মহিলা যে মেয়ের গাড়ি চালানো নিয়ে আপত্তি করবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী! নবনী স্বামীকে বলেছিলেন, ‘‘আহি গাড়ি চালিয়ে কী করবে? আমাদের ড্রাইভার আছে, তোমার অফিসের গাড়ি আছে, তুমি নিজে গাড়ি চালাতে পারো। আর কী লাগবে?’’
কমলেশ রায় হেসে বলেছিলেন, ‘‘তোমার যদি মাঝরাতে ময়দানে হাওয়া খেতে ইচ্ছে করে নবনী? অত রাতে
তো ড্রাইভার পাবে না। আমিও ঘুমোব। মেয়েই তখন ভরসা। তোমাকে নিয়ে যাবে।’’
‘‘কলকাতার রাস্তাঘাট এখন খুব বাজে। সারা ক্ষণ শুধু অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে।’’
আহিরী বলেছিল, ‘‘মা, স্ট্যাটিসটিক্স বলছে, মেয়েরা অনেক কম অ্যাক্সিডেন্ট করে। তারা বেশি অ্যালার্ট, ধীরস্থির। ডোন্ট ওরি।
খুব শিগগিরই তোমাকে আর বাবাকে নিয়ে আমি লং ড্রাইভে যাব। চলো, দোলের সময় আমরা শান্তিনিকেতন যাই।’’
নবনী জোর গলায় বলেছিলেন, ‘‘যাব না।’’
শেষ পর্যন্ত অবশ্য যাওয়া হয়েছিল। বর্ধমান পর্যন্ত কমলেশ গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যান। বাকি পথ স্টিয়ারিং ধরেছিল আহিরী। সুন্দর নিয়ে গেছে। রাস্তা কোনও কোনও জায়গা খারাপ ছিল। তার পরেও ঝঁাকুনি কম দিয়েছে। যদিও নবনীকে প্রথম দিকটা দেখে মনে হচ্ছিল, দম বন্ধ করে বসে আছেন।
গাড়ি নিয়ে কলেজে এলে সুবিধে হয়। খরচ কম। তার থেকে বড় কথা, দেরি করে বাড়ি থেকে বেরনো যায়। বাস, ক্যাব, মেট্রোর জন্য তাড়াহুড়ো করতে হয় না। কলেজের পর দরকার মতো এ দিক-সে দিক যাওয়া যায়। বিতানের সঙ্গে দেখা করাটা সহজ হয়। দু’জনে এ দিক-ও দিক চলে যায়। বিতান রসিকতা করতে ছাড়ে না।
‘‘রূপকথায় পড়েছি, রাজকুমার ঘোড়া নিয়ে এসে দঁাড়াত, রাজকন্যা লাফ দিয়ে উঠত পিঠে। রাজকুমার তখন ঘোড়া ছোটাত টগবগ টগবগ। এখন হচ্ছে উলটো। রাজকন্যা গাড়ি নিয়ে আসছে, রাজকুমার দরজা খুলে লাফ দিয়ে উঠছে। রাজকন্যা গাড়ি ছোটাচ্ছে সঁাইসঁাই করে।’’
আহিরী গিয়ার বদলে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয়। বলে, ‘‘তাও তো তুমি নিজেকে রাজকুমার ভাবতে পারছ।’’
বিতান হেসে বলে, ‘‘বেকার রাজকুমার।’’
নিজের গাড়িতে চড়ে অভ্যেস হয়ে গেছে আহিরীর। এখন গাড়ি ছাড়া চলাচল করতে অসুবিধে হয়। গাড়ি ছাড়া কলেজে এলে সিস্টেমে গোলমাল হয়ে যাবে।
পরীক্ষা চলার সময় দোতলা থেকে হালকা হট্টগোল ভেসে আসছিল। আহিরী গা করল না। কে জানে, ঝগড়া-টগড়া লেগেছে হয়তো। তিন নম্বর রো–এ একটা মেয়ে ওড়নার নীচে মোবাইল রেখে উত্তর টুকছিল। আহিরী তাকে হাতেনাতে ধরল। পুরুষ ইনভিজিলেটর হলে ধরা কঠিন
ছিল। ছাত্রী হোক আর যাই হোক, সে তো একটা মেয়েকে বলতে পারত না, ‘‘দেখি তোমার ওড়নাটা সরাও তো।’’ বললে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে যেত। এই মেয়ে সম্ভবত সেই ভাবেই তৈরি হয়ে এসেছিল। ভাবতে পারেনি, তার ঘরেই কোন ম্যাডাম
গার্ড দেবে।
আহিরী কাছে গিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘‘দাও, মোবাইলটা দাও।’’
‘‘আর হবে না ম্যাডাম।’’
আহিরী কড়া গলায় বলল, ‘‘মোবাইলটা দাও।’’
মেয়েটি কঁাপা হাতে মোবাইল এগিয়ে দিল।
‘‘তোমার নাম কী?’’
‘‘আর করব না।’’
আহিরী কড়া গলায় বলল, ‘‘নাম কী তোমার? কোন ইয়ার?’’
মেয়েটি মাথা নামিয়ে বলল, ‘‘উর্বী সেন। সেকেন্ড ইয়ার।’’
আহিরী বলল, ‘‘এখনই এ সব শুরু করে দিলে? মোবাইলে কে তোমাকে উত্তর পাঠাচ্ছে?’’
উর্বী নামের মেয়েটি চুপ করে রইল। আহিরী বলল, ‘‘আর ক’দিন পরীক্ষা বাকি আছে?’’
‘‘দু’দিন ম্যাম।’’
আহিরী বলল, ‘‘ইচ্ছে করলে আমি তোমার খাতায় নম্বর মাইনাস করে দিতে পারি। খাতা ক্যানসেলও করে দিতে পারি। কিন্তু আমি সে সব কিছু করছি না। পরীক্ষা দাও। মোবাইল আমার কাছে রইল। অফিসে জমা থাকবে। দু’দিন পরে পাবে। এটাই তোমার পানিশমেন্ট।’’
পরীক্ষা শেষ হলে, অফিসে খাতা দিল আহিরী। বাজেয়াপ্ত করা মোবাইল ফোন জমা দিতে গেলে নির্মাল্য বলল, ‘‘এটা কী?’’
‘‘সেকেন্ড ইয়ারের উর্বী সেন। ফোন দেখে টুকছিল। এক দিন আটকে রেখে দিয়ে দেবেন।’’
নির্মাল্য হেসে বলল, ‘‘বাপ রে, মোবাইল নিয়েছেন! এর থেকে ওকে আটকে রাখলে বেঁচে যেত। এখনকার ছেলেমেয়েরা মোবাইল ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না।’’
আহিরী বলল, ‘‘শুধু ছেলেমেয়েদের দোষ দিয়ে কী হবে? আমরাও কি পারি?’’
টিচার্স রুমে এল আহিরী। ব্যাগ গুছিয়ে নিল। এ বার শর্মিষ্ঠা দত্তর কাছে যাবে। গিয়ে বলবে, পরীক্ষার আর দু’দিন বাকি রয়েছে। আর যেন তাকে ডিউটি না দেওয়া হয়। এ বার যারা দেয়নি, তারা দেবে। তার পরেও যদি রোস্টারে তার নাম রাখা হয়, সেও ব্যবস্থা নেবে। সিক লিভ নিয়ে নেবে।
যতটা সম্ভব মাথা ঠান্ডা করে টিচার্স রুম থেকে বেরল আহিরী। দোতলায় টিচার-ইন-চার্জের অফিস। সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই শুনতে পেল, ওপরে হইহট্টগোল হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা চিৎকার করছে। কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না। থমকে দঁাড়াল আহিরী। ঝনঝন করে কাচ ভেঙে পড়ল। কিছু ক্ষণের মধ্যেই মাটির কিছু একটা ভাঙা হল। তার পর চেয়ার ওলটানোর আওয়াজ। আহিরী কী করবে বুঝতে পারছে না। সে কি ওপরে যাবে? আবার ভাঙচুরের আওয়াজ। এ বার নীচেও ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে। দুদ্দাড় করে ওপরে উঠছে। আহিরী এগোতে গিয়ে দেখল, গোপাল রক্ষিত দু’জন সিকিয়োরিটি গার্ডকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসছে।
‘‘কী হয়েছে?’’ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল আহিরী।
‘‘জানি না দিদি। শর্মিষ্ঠা ম্যাডাম ফোন করে ডেকে পাঠালেন। সায়েন্সের কোয়েশ্চেনে কী গোলমাল হয়েছে বলে ছেলেমেয়েরা নালিশ করতে গিয়েছিল, ম্যাডাম ভাগিয়ে দিয়েছে। ওরা ঘরের বাইরে এসে ভাঙচুর শুরু করেছে। আপনারা ওপরে যাবেন না।’’
তত ক্ষণে আরও টিচাররা চলে এসেছে। সিঁড়ির মুখে জটলা। জানা গেল, অর্কপ্রভ সেন সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন করেছেন। পরীক্ষা চলার সময়ে ছেলেমেয়েরা তাঁকে জানায়। উনি বলেছেন, ‘‘এটা প্রাইমারি স্কুল নয় যে যা পড়াব তাই পরীক্ষায় আসবে। পরীক্ষা দিলে দেবে, না দিলে না দেবে।’’ পরীক্ষার পর ছেলেমেয়েরা টিটার-ইন-চার্জের ঘরে গেলে তিনি যাচ্ছেতাই বলে প্রায় গলাধাক্কা দিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে এসে দরজার কাচ ভেঙেছে। করিডরে রাখা মাটির টব ভেঙেছে।
এ বার ওপরে স্লোগান শুরু হল, ‘‘নতুন ভবনের কোটি টাকা কোথায় গেল, শর্মিষ্ঠা দত্ত জবাব দাও।’’
সিকিয়োরিটির লোকরা ওপরে গেলে ছাত্রদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঘটনা জটিল দিকে বঁাক নিল। ছাত্রদের মারা হয়েছে এবং ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছে, এই অভিযোগে কলেজের মেন গেট আটকে ছেলেমেয়েরা সিঁড়িতে বসে পড়ে। টিচারদের কলেজ থেকে বেরতে দেওয়া হবে না। জানা গেল, শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছে সেকেন্ড ইয়ারের উর্বী সেন নামে এক ছাত্রী। নাম শুনে আহিরী অবাক হল। এই মেয়ে মোবাইল থেকে টুকছিল না?
কর্মজীবনে এই ধরনের পরিস্থিতিতে আহিরী আগে কখনও পড়েনি। আজ বিতানের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। সে ফোন বের করে নম্বর টিপল।
‘‘যেতে পারছি না।’’
বিতান মুখে চুকচুক আওয়াজ করে বলল, ‘‘ইস, আমি সেভ করে, চুল অঁাচড়ে, ভাল শার্ট পরে তৈরি হলাম আর তুমি বলছ যেতে পারছি না। একটু পরেই না হয় এলে!’’
‘‘ঠাট্টা কোরো না। বেরতে রাত হতে পারে।’’
বিতান অঁাতকে উঠে বলল, ‘‘অ্যঁা! কলেজের প্রফেসরদেরও কি নাইট ডিউটি শুরু হল? ভাগ্যিস লেখাপড়া শিখিনি!’’
আহিরী গলা নামিয়ে বলল, ‘‘ঘেরাও হয়েছি। স্টুডেন্টরা গেট আটকে বসে পড়েছে। চিৎকার শুনতে পাচ্ছ না?’’
বিতান বলল, ‘‘এই রে! আমি যাব?’’
আহিরী বলল, ‘‘কী করবে? আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে?’’
বিতান চিন্তিত হওয়ার ভান করে বলল, ‘‘তাও তো বটে। আমি গিয়েই বা কী করব? তার পরেও যদি বলো, তোমার বিপদের সময় পাশে না থাকাটা কি ঠিক হবে...’’
বিতানের নাটকীয় ভাবে বলার ঢঙে আহিরী হেসে ফেলল। বলল, ‘‘আমার কোনও বিপদ হয়নি। ঠাট্টা বন্ধ করে তুমি নেক্সট উইকের জন্য ঠিকমত তৈরি হও।’’
বিতান বলল, ‘‘কী আর তৈরি হব? বাড়িতে বলে পড়ার তো কিছু নেই। কোয়েশ্চেন তো সবই আনকমন। তার থেকে এক জন জ্যোতিষীর কাছে গেলে কেমন হয়?’’
আহিরী অবাক গলায় বলল, ‘‘জ্যোতিষী!’’
‘‘চমকে উঠলে কেন? একটা চান্স নিতাম। যদি কোয়েশ্চেনের প্যার্টান বলে দিতে পারে। আজকাল জ্যোতিষীরা নানা রকম অ্যাপ ব্যবহার করছে। সে সব কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের কাছাকাছি যদি আসতে পারে।’’
আহিরী কথার মাঝখানেই বলল, ‘‘প্লিজ বি সিরিয়াস। বিতান, এ বার তোমার ভদ্রস্থ একটা কাজ পাওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।’’
বিতান একটু চুপ করে থেকে সামান্য হেসে বলল, ‘‘ভদ্রস্থ কাজ পেতে হলে এক জন ভদ্রলোক হতে হবে তো। আহিরী, আমি তো প্রপার ভদ্রলোকই নই।’’
আহিরী নিজের ভুল বুঝতে পারল। কথাটা বেশি রুক্ষ হয়ে গেছে। এ ভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। সে চাপা গলায় বলল, ‘‘স্যরি। আমি ও ভাবে বলিনি। তুমি একটা ভাল চাকরিবাকরি পেলে আমার ভাল লাগবে। তুমি ঠিক পাবে। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।’’
ক্রমশ