কাতারে চলছে ফুটবল বিশ্বকাপ। মাঠে লড়াই করছেন মেসি-নেমার-রোনাল্ডোরা। সারা দুনিয়ার চোখ টিভি বা মোবাইলের পর্দায়। চলছে মরণ-বাঁচন ম্যাচ। আর সেই উত্তাপে একটু বেশিই সরগরম কেরলের কাতার গ্রাম। এক ঝলক দেখলে মনে হতে পারে হ্রদের ধারে এই শহরেই বসেছে বিশ্বফুটবলের আসর।
কাতার থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে কেরলের এই ছোট গ্রামে এখন শুধু মেসি, রোনাল্ডো নয়, ঝুলছে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পোস্টার, ব্যানারও। এ গ্রামের বাসিন্দারা শারীরিক ভাবে এ দেশে থাকলেও মনটা পড়ে কাতারে। কারণ তাঁদের প্রিয়জন থাকেন সেখানে।
গ্রামের নাম কেত্তুঙ্গল। যদিও ‘কাতার গ্রাম’ নামেই বেশি পরিচিত। কেরলের ত্রিশূর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে এই গ্রাম। এনামাক্কাল হ্রদের ধারে।
কেন এই নাম? এই গ্রামের প্রতি পরিবারে অন্তত এক জন কাজ করেন কাতারে। কেত্তুঙ্গলের অন্তত ৩৫০ জন বাসিন্দা এখন কাজ করেন ওই দেশে।
এ বারের ফুটবল বিশ্বকাপ হচ্ছে কাতারে। গোটা গ্রামের বাসিন্দারা তাই উদ্যাপনে সামিল। যে দেশের জন্য তাঁদের সংসার চলে, সেই দেশকে ধন্যবাদ দিতে চাইছেন গ্রামবাসীরা। গ্রামের বাড়িগুলির দেওয়াল রং করেছেন মেরুন আর সাদায়। ওটাই কাতারের জাতীয় পতাকার রং।
সিদ্ধান্তটা প্রথম নিয়েছিল এনামাক্কাল কেত্তুঙ্গল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। তারা স্থির করে, বিশ্বকাপ যতই কাতারে হোক, নিজেদের গ্রামে উদ্যাপন হওয়া দরকার। এর পরেই গঠন করা হয় কমিটি। কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই কাতারফেরত বা সেখানে এখনও রয়েছেন।
কাতারে যে দিন বিশ্বকাপ শুরু হয়, সে দিনই এই গ্রামেও উদ্যাপন শুরু করে কমিটি। উপস্থিত ছিলেন কেরলের রাজস্বমন্ত্রী কে রাজন।
কেত্তুঙ্গলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সামিল হন প্রায় দু’হাজার মানুষ। তাঁরা পরেছিলেন মেরুন এবং সাদা রঙের পোশাক। কাতারের জাতীয় পতাকার রংও হল এই মেরুন-সাদা। সে দিন গ্রামের রাস্তা দিয়ে মিছিলে শামিল ছিল উটও।
মনে করা হয়, ১৯৫২ সাল থেকে কেত্তুঙ্গলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু কাতারের। আবদুল আজিজ নামে এক ব্যক্তি গিয়েছিলেন কাতারে, কাজের খোঁজে। তখনও কাতারকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্রিটেন।
আবদুল গিয়ে প্রথমে ঠিক কী কাজ করতেন, জানা যায়নি। পরে একটি ব্রিটিশ ব্যাঙ্কে কাজ নেন তিনি।
জালালউদ্দিন হাজি নামে গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘আমাদের গ্রাম খুব গরিব ছিল। গ্রামে তখন সব ভাঙাচোরা কাঁচা বাড়ি। বেশির ভাগই চাষের কাজ করতেন। নয়তো মাছ ধরতেন। কাতারই এ গ্রামের মানুষদের জন্য নতুন পথ খুলে দিয়েছিল।’’
হাজি জানালেন, গ্রাম থেকে প্রথমে আবদুলই কাতার যান। পরে একে একে তাঁর আত্মীয়-বন্ধুরা যান। এর পরেই বদলাতে থাকে ছবিটা। আশির দশকে কাতারে গিয়েছিলেন হাজি। তিনি দরজির কাজ করতেন সেখানে। তিনি জানালেন, এখন গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ আগে ব্যবসা করতে চায়। তার পর পড়াশোনা।
হাজি জানালেন, কাতারে কাজ করতে যাবেন বলেই দরজির দোকানে গিয়ে কাজ শিখেছিলেন। সেই আশির দশকে। কেত্তুঙ্গলের কিছু যুবক আবার টাইপিং শিখতেন। কেউ শিখতেন গাড়ি চালানো, কেউ রান্নাবান্না। সবার উদ্দেশ্য একটাই, কাতারে গিয়ে কাজ পাওয়া।
তবে সে সময় সকলে সফল হননি। হাজি জানালেন, অনেকেই চোরাপথে নথি ছাড়া কাতার যাওয়ার চেষ্টা করতেন। কেউ প্রথমে জাহাজের খালাসি হয়ে এবং পরে সমুদ্রে কিছুটা পথ সাঁতরে কাতারে পৌঁছতেন। অনেকেরই মৃত্যু হত উপকূলরক্ষীদের গুলিতে। অনেকে বন্দি হতেন।
কাতারে গিয়ে কেমন ছিল অভিজ্ঞতা? হাজি জানালেন, গ্রামে যা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, সে রকমই ছিল জীবন। এসি ঘর, টেলিফোন— সবই নতুন ছিল তাঁদের কাছে। হাজির কথায়, ‘‘এখন যাঁরা কাতার যান, তাঁদের কাছে এ সব অতটাও নতুন নয়। তাঁরা আমাদের থেকে অনেক বেশি শিক্ষিতও।’’
বিশ্বকাপে কি কাতারকেই সমর্থন করেছে কেত্তুঙ্গল? কাতারফেরত কামরুদ্দিনের কথায়, ‘‘জানতাম জিতবে না, তবু কাতারকেই সমর্থন করেছিলাম। অন্নদাতা দেশ বলে কথা।’’