উইলিয়াম লিটল। জন্ম ১৯৩১ সালে আয়ারল্যান্ডে। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু আয়ারল্যান্ডে বেশি দিন থাকেননি তিনি। লন্ডনের পূর্ব দিকে হ্যাকনের বাসিন্দা ছিলেন উইলিয়াম। হ্যাকনের লন্ডন বরোতে ২০টি ঘরবিশিষ্ট একটি বাড়ি কিনেছিলেন তিনি। তবে উইলিয়াম তাঁর জীবৎকালে এমন কাজ করেছিলেন যে, তাঁর কীর্তির জন্য শহর জুড়ে কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
সময়কাল ষাটের দশকের মাঝামাঝি। হঠাৎ তাঁর ইচ্ছা হল, বাড়ির তলায় ওয়াইন রাখার একটি আলাদা ঘর তৈরি করবেন তিনি। যেমন ইচ্ছা, তেমন কাজ। নিজেই বাড়ির তলায় মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন তিনি। তাঁর সংগ্রহে থাকা ওয়াইন রাখার মতো একটি ছোট ঘরও তৈরি করে ফেললেন।
কিন্তু এর পরেই উইলিয়ামের ইচ্ছা ডানা মেলতে থাকে। ছোট ওয়াইন সেলার তৈরিতেই থেমে থাকলেন না তিনি। আরও মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন উইলিয়াম। আগে যতটা মাটি খুঁড়েছিলেন, তার থেকেও দ্বিগুণ আকারের ঘর বানাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
ঝোঁকের বশে মাটি খুঁড়ে একের পর এক সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চললেন উইলিয়াম। শুধু মাত্র নিজের বাড়ির নীচেই নয়, ধীরে ধীরে নিজের বাড়ির আশপাশে বহু দূর পর্যন্ত সুড়ঙ্গ খোঁড়েন তিনি। কোনও কোনও সুড়ঙ্গ ২৬ ফুট গভীর, আবার কোনও সুড়ঙ্গের গভীরতা ৬৬ ফুট!
একটানা ৪০ বছর ধরে মাটি খুঁড়ে চলেছিলেন উইলিয়াম। কিন্তু এত মাটি কোথায় জমিয়ে রাখবেন, তা বুঝতে পারছিলেন না তিনি। প্রথমে বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া বাগানে মাটি ফেলতে শুরু করেন তিনি। তার পর বাড়ির প্রতিটি খালি ঘর মাটি দিয়ে ভর্তি করতে থাকেন উইলিয়াম।
অধিকাংশের দাবি, একটি সুড়ঙ্গ ডালস্টন লেন পর্যন্ত এবং আর একটি সুড়ঙ্গ নিকটবর্তী রেল স্টেশন পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছিলেন উইলিয়াম। অনেক সময় সুড়ঙ্গ খুঁড়তে খুঁড়তে তিনি জলস্তর পর্যন্ত পৌঁছে যেতেন।
উইলিয়ামের কাণ্ডকারখানায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর প্রতিবেশীরা। উইলিয়াম মাটি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করার সময় জলের সমস্যা দেখা দিত ওই এলাকায়। এমনকি, মাটির নীচে থাকা বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে মাঝেমধ্যেই এলাকায় লোডশেডিং হয়ে যেত। উইলিয়ামের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে শুরু করেছিলেন তাঁর প্রতিবেশীরা।
উইলিয়ামের বাড়ির কাছে একটি ‘পাব’ ছিল। তার মালিকও অভিযোগ করেছিলেন উইলিয়ামের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, পাবের নীচেও সুড়ঙ্গ বানিয়েছিলেন উইলিয়াম। ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে ধসে পড়ে পাবের মদ রাখার সেলার।
হ্যাকনে কাউন্সিলে উইলিয়ামের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হলেও তাঁর বিরুদ্ধে প্রথমে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। কিন্তু দিনের পর দিন অযত্নের ফলে উইলিয়ামের বাড়ির পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে পড়ে। তখন কাউন্সিলের আধিকারিকদের নজরে পড়ে বিষয়টি।
২০০৬ সালে উইলিয়ামের বাড়ির চারপাশে আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে সুড়ঙ্গের গভীরতা মাপা হয়। উইলিয়ামের বাড়ির অবস্থা দেখে তাঁকে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এমনকি, হ্যাকন বরো কাউন্সিলের তরফে সব সুড়ঙ্গ কনক্রিট দিয়ে বুজিয়েও দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আদালতের শরণাপন্ন হন উইলিয়াম।
কিন্তু আদালতের তরফে জানানো হয় যে, ক্ষতিপূরণ হিসাবে উইলিয়ামকে ২ লক্ষ ৯৩ হাজার পাউন্ড অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩ কোটি টাকা দিতে হবে। উইলিয়ামকে ৩ বছরের জন্য একটি হোটেলে থাকার নির্দেশও দেওয়া হয়।
তার পর একটি বহুতল অ্যাপার্টমেন্টের সবচেয়ে উপরের তলায় উইলিয়ামকে রাখা হয়। উপরের তলায় থাকলে তিনি আর সুড়ঙ্গ খুঁড়তে পারবেন না ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে গিয়েও বাড়ির দেওয়ালে ফুটো করে ফেলেন তিনি। দেওয়ালে গর্ত তৈরি করে দুই ঘরে যাতায়াত করতেন উইলিয়াম।
২০১০ সালে উইলিয়াম মারা যান। তাঁর মৃত্যুর দু’বছর পর বাড়িটি প্রায় ১১ কোটি টাকা মূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হয়। উইলিয়ামের বাড়ি থেকে ৩৩ টন মাটি পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ৩টি গাড়ি এবং একটি নৌকার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় উইলিয়ামের বাড়ি থেকে। মনে করা হয় এই সব জিনিস তিনি মাটি খুঁড়তে গিয়ে পেয়েছিলেন।
২০০৬ সালে একটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন উইলিয়াম। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘কোনও কাজে লাগবে না জেনেও সুন্দর জিনিস গড়ে তোলার এক আলাদা মজা রয়েছে। অনেকেই আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে যে এই সৃষ্টির পিছনে কী কারণ রয়েছে। কিন্তু এর উত্তর আপনার জানা। এমন সুন্দর সৃষ্টির পিছনে কোনও কারণ থাকে না।’’
উইলিয়াম তাঁর কীর্তির জন্য হ্যাকনের ‘মোল ম্যান’ হিসাবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। ২০২০ সালে উইলিয়ামের বাড়ি পুনর্নির্মাণ করেন স্থপতি ডেভিড আ্যাডজায়ে। ব্রিটেনের জনপ্রিয় শিল্পী স্যু ওয়েবস্টার এই বাড়িতে থাকা শুরু করেন। এই বাড়ির একটি অংশ তাঁর স্টুডিয়ো হিসাবেও ব্যবহার করা হয়।