চিনা সেনায় যেন ‘সাফাই অভিযান’ শুরু করেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। আতশকাচ দিয়ে খুঁজছেন দুর্নীতির শিকড়। কোথাও কোনও গোলমালের গন্ধ পেলেই ধেয়ে আসছে হাতকড়া।
গত কয়েক দিনে চিনা সেনাবাহিনীর বেশ কয়েক জন শীর্ষ কর্তাকে গ্রেফতার করেছে জিনপিংয়ের পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে নানা প্রকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনিক স্তরেও গ্রেফতারি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের চিনা সদস্য জেনিফার জেং তাঁর এক্স হ্যান্ডলে বেশ কয়েক জন উচ্চপদস্থ চিনা সামরিক আধিকারিকের নামের তালিকা প্রকাশ করেছেন। কোনও না কোনও অভিযোগে সম্প্রতি তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
জেনিফার জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনীতে ‘শুদ্ধিকরণ অভিযান’ শুরু করেছেন জিনপিং। তারই ফলস্বরূপ এই গ্রেফতারি। সামরিক পরিসরে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি রোধের তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে খবর।
জিনপিংয়ের গ্রেফতারির তালিকায় প্রথমেই আছেন লিউ শিকুয়া। তিনি চিনের নর্থ ইন্ডাস্ট্রিস সামরিক গ্রুপ কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। সামরিক বিভাগে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে তাঁর এই পদের।
জিনপিংয়ের পুলিশ সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে ইউয়ান জিয়েকে। তিনি চিনা এরোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। চিনের মহাকাশ গবেষণা বিভাগে কদর ছিল এই কর্তার।
চিনের নর্থ ইন্ডাস্ট্রিস সামরিক গ্রুপ কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজারকেও দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁর নাম চেন গুয়োয়িং।
জিনপিংয়ের শুদ্ধিকরণ অভিযানের বলি হয়েছেন তান রুইসং। তিনি চিনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) প্রাক্তন সচিব। এ ছাড়া, চিনের অ্যাভিয়েশন (বিমান চলাচল) ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। গত মার্চ মাসে তাঁকে পদচ্যুত করা হয়েছিল।
চিনের সামরিক বিভাগের এই উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের গ্রেফতার করেছে সিসিপি-র শৃঙ্খলা পরিদর্শনের কেন্দ্রীয় কমিশন। মনে করা হচ্ছে, এই সংক্রান্ত কারণে আরও কয়েক জন শীর্ষকর্তাকে গ্রেফতার করা হবে।
সম্প্রতি, চিনের সামরিক বাহিনীর কর্মস্থলে ঢুঁ মেরে এসেছেন স্বয়ং জিনপিং। সৈনিকদের সঙ্গে দেখা করেছেন, কথাও বলেছেন। তাঁর পরিদর্শন থেকেই স্পষ্ট, সামরিক বিভাগকে কতটা গুরুত্ব সহকারে দেখছেন প্রেসিডেন্ট।
প্রাক্তন চিনা সাংবাদিক মাতৃভাষায় একটি টুইট করে জানিয়েছেন, সিসিপি-র শৃঙ্খলা পরিদর্শনের কেন্দ্রীয় কমিশন দেশের সামরিক বিভাগ, মহাকাশ, বিজ্ঞান, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি বিভাগে সাধারণত সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না। তাদের এই তৎপরতা যথেষ্ট বিরল।
গ্রেফতার হওয়া শীর্ষ আধিকারিকদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই মূলত একটি অভিযোগ রয়েছে। তা হল, তাঁরা প্রত্যেকেই স্বজনপোষণের সঙ্গে জড়িত। কোনও না কোনও সময় নিজস্ব বিভাগে কর্মচারী নিয়োগের সময় স্বজনপোষণ করেছেন এঁরা।
জিনপিংয়ের এই ‘সাফাই অভিযান’ প্রসঙ্গে আমেরিকার প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ফ্লিন বলেন, ‘‘এই ধরনের শুদ্ধিকরণের অর্থ উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকদের উপর সরকারের সম্পূর্ণ রূপে আস্থা হারানো।’’
দুর্নীতিদমনে আচমকা এই তৎপরতা চিনের অন্য শীর্ষকর্তাদের মধ্যেও ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছে। তাঁরাও মনে করছেন, তাঁরা সরকারের পরবর্তী ‘টার্গেট’ হতে চলেছেন। ফলে সার্বিক ভাবে জিনপিংয়ের প্রশাসনের এখন টলমল দশা।
চিনের অর্থনীতির হালও খুব একটা ভাল নয়। দেশটি মুদ্রাসঙ্কোচনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে জিনিসের দাম বৃদ্ধির পরবির্তে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। খরচের বদলে বেশি করে টাকা জমাচ্ছেন মানুষ।
সরকারের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের অবিশ্বাস, আস্থা হারানোর কারণেই এই অর্থ সঞ্চয়ের প্রবণতা বেড়েছে। ফলে জিনিসের জোগান আছে, কিন্তু কমে গিয়েছে চাহিদা।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিকে সঙ্কটমুক্ত করে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জিনপিংয়ের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের আস্থা অর্জনে কি সচেষ্ট হয়েছেন জিনপিং?
অনেকের মতে, সামরিক, প্রশাসনিক বিভাগে শুদ্ধিকারণ অভিযান চালিয়ে, দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিকদের শাস্তি দিয়ে জনগণের আস্থা ফেরাতে চাইছেন জিনপিং। তা কার্যক্ষেত্রে কতটা রূপায়িত হবে, সময় বলবে।