মানব পাচারের অভিযোগে দুবাই থেকে নিকারাগুয়ার উদ্দেশে উড়ে যাওয়া একটি বিমানকে আটকানো হয়েছিল ফ্রান্সের শালোন-ভ্যাত্রি বিমানবন্দরে। বেশ কয়েক দিনের টালবাহানার পর মঙ্গলবার মুম্বই বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে বিমানটি।
তবে মঙ্গলবার আটক বিমানে সওয়ার হয়ে ২৭৬ জন যাত্রী ভারতের মাটিতে পা রাখলেও দুই শিশু-সহ মোট ২৭ জন যাত্রী ফ্রান্সেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কেন তাঁরা ফ্রান্সে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তা নিয়ে নানা জল্পনা শুরু হয়েছে। কারও কারও মতে, তাঁরা নাকি বিমানটির পূর্বনির্ধারিত গন্তব্য নিকারাগুয়াতেই যেতে চেয়েছিলেন, পরিবর্তিত গন্তব্যস্থল ভারতে নয়।
আগেই জানা গিয়েছিল যে, বিমানটিতে থাকা ৩০৩ জন যাত্রীর মধ্যে অধিকাংশই ভারতীয়। তবে ফ্রান্সে থেকে যাওয়া ২৭ জন যাত্রী কোন দেশের নাগরিক, তা প্রকাশ্যে আনতে চায়নি ফরাসি প্রশাসন।
এই ২৭ জনই ফ্রান্সের কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, কোনও ব্যক্তি কোনও দেশের প্রশাসনের কাছে আশ্রয় চাইলে তাঁকে জোরপূর্বক তাঁর দেশে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।
তবে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে যখন উন্নত দেশগুলি জেরবার, তখন ফ্রান্স এই যাত্রীদের সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজখবর নিয়েই আশ্রয় চাওয়ার আর্জি মঞ্জুর করবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই প্যারিস বিমানবন্দরে ওই যাত্রীদের কাগজপত্র খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে ফরাসি পুলিশ।
এই যাত্রীদের মধ্যে দু’জনের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের বেশ কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। বাকিদের আপাতত ফ্রান্সে থাকার অনুমতি দেওয়া হলেও ওই দু’জনকে দেশ ছাড়তে বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁদের আইনজীবী।
গত শুক্রবার জ্বালানি ভরার জন্য প্যারিস থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে শালোন-ভ্যাত্রি বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিল আদতে নিকারাগুয়ার উদ্দেশে উড়ে যাওয়া ওই বিমানটি। বিমানে যাত্রীদের মধ্যে ছিল ১১টি শিশু, যাদের কোনও অভিভাবক ছিল না।
ফরাসি প্রশাসনের সন্দেহ হয় যে, পাচারের উদ্দেশ্যেই তাদের নিকারাগুয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তৎক্ষণাৎ বিমানটিকে আটক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আটকে পড়া যাত্রীদের জন্য বিমানবন্দর চত্বরেই থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়।
যে বিমানকে ঘিরে এক শোরগোল, সেটি রোমানিয়ার সংস্থা লিজেন্ড এয়ারলাইনসের মালিকানাধীন। এই ঘটনায় অসন্তুষ্ট বিমান সংস্থাটিও। তাদের দাবি, ওই উড়ানে শুধুমাত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছিল তারা। মানব পাচার হচ্ছিল কি না, সেই বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই।
ওই সংস্থার বিরুদ্ধে ফরাসি সরকার কোনও পদক্ষেপ করলে পাল্টা আইনি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারিও দেন তাদের আইনজীবী। যদিও ফ্রান্সের সংগঠিত অপরাধ দমন শাখা ‘জুনালকো’ বিমানটির সঙ্গে কোনও অপরাধচক্র যুক্ত কি না, তার তদন্ত শুরু করেছে।
এমনিতে ফ্রান্সে মানব পাচারের জন্য কোনও ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ ২০ বছরের জন্য তাঁকে সাজা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে কেবল মানব পাচার নয়, ফরাসি প্রশাসন এই বিমান নিয়ে অন্য আশঙ্কাও করছে।
সংবাদ সংস্থা এএফপি একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানায়, বিমানের ভারতীয় যাত্রীরা সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে কাজ করতেন। তাঁরা নিকারাগুয়া হয়ে আমেরিকা বা কানাডায় যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
এই খবরের সূত্রে অনেকেরই মনে পড়ছে ‘ডাঙ্কি ফ্লাইট’-এর কথা। কারণ নিকারাগুয়া দিয়ে প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করেন। মূলত নথিপত্র সংক্রান্ত কড়াকড়ি কম হওয়ার কারণেই এই পথ বেছে নেন তাঁরা।
আমেরিকার শুল্ক দফতরের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের একটি গোটা আর্থিক বছরে প্রায় ৯৭ হাজার ভারতীয় আমেরিকায় আশ্রয় চেয়েছেন। এঁদের অধিকাংশই মেক্সিকো এবং নিকারাগুয়া হয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করতে চেয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে ওই পরিসংখ্যানে।
এই বিমানের যাত্রীরাও নিকারাগুয়া হয়ে জো বাইডেনের দেশে ঢোকার অনুমতি চাইতেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে যাত্রীদের প্রায় সকলকেই জিজ্ঞাসাবাদের পর গত রবিবার বিমানটিকে উড়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় ফ্রান্সের একটি আদালত।
আমেরিকার অন্যতম মিত্র দেশ হিসাবে ফ্রান্স বিষয়টিকে খুব একটা লঘু করে দেখবে বলে মনে করছেন না অনেকেই। ঘটনাচক্রে, যে দিন এই বিমানটিকে আটক করা হয়, সে দিনই প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রধান অতিথি হিসাবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁর নাম ঘোষণা করে ভারত।
ফ্রান্সের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বেশ ভাল। এই পরিস্থিতিতে আর এক বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা মাথায় রেখেই ফ্রান্স এই নিয়ে বেশি অগ্রসর হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
কারণ ফরাসি প্রশাসনের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, বিচারবিভাগীয় তদন্তের প্রাথমিক পর্বে মানব পাচারের সপক্ষে এখনও পর্যন্ত জোরালো কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে একটি বিমানকে ঘিরে যে ভাবে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে আর একাধিক দেশের পারস্পরিক সম্পর্কেও যে ভাবে সেটি প্রভাব ফেলছে, তা নজিরবিহীন বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।