এশিয়ার মধ্যভাগে পাহাড়ে ঘেরা দেশ কিরঘিজ়স্তান। ভারতের উত্তর-পশ্চিম কোণ বরাবর অন্তত দু’টি দেশ পেরিয়ে কিরঘিজ় মুলুকে যাওয়া যায়। সম্প্রতি শিরোনামে উঠে এসেছেন সেই কিরঘিজ়রাই।
কিরঘিজ়স্তানের উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে কাজ়াখস্তান। পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে রয়েছে চিনের বিস্তৃত সীমান্ত। এ ছাড়া, দেশটির দক্ষিণে রয়েছে তাজিকিস্তান এবং পশ্চিমে রয়েছে উজবেকিস্তান।
মধ্য এশিয়ার দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত হলেও কিরঘিজ়স্তান কিন্তু ভারতীয়দের কাছে একেবারে অপরিচিত বা অগম্য নয়। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে ভারত থেকে এই দেশে পাড়ি দিয়ে থাকেন।
ভারত তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশের পড়ুয়াদের মধ্যে কিরঘিজ়স্তান বেশ জনপ্রিয়। কারণ, মধ্য এশিয়ার এই দেশটিতেই প্রতি বছর হাজার হাজার পড়ুয়া ডাক্তারি পড়তে যান।
কিরঘিজ়স্তানে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া এশিয়ান ছাত্রছাত্রীদের উপর সম্প্রতি আক্রমণ হয়েছে। দেশটি তাই হঠাৎ উঠে এসেছে শিরোনামে। অভিযোগ, শুধু ভারত নয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি পড়ুয়ারাও ওই দেশে আক্রান্ত। তাঁদেরও প্রাণ বিপন্ন।
বিদেশিদের উপর আক্রমণের অভিযোগে এর আগে কখনও শিরোনামে উঠে আসেনি কিরঘিজ়স্তান। বরং বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের বছরের পর বছর ধরে পরম মমতায় আপ্যায়নই এই দেশের পরম্পরা।
তবে কেন আচমকা চিনের এই আপাতনিরীহ পড়শির বিরুদ্ধে এমন অশান্তির অভিযোগ উঠল? কী কারণে বিদেশিদের উপর খড়্গহস্ত হয়ে উঠলেন কিরঘিজ়রা?
কিরঘিজ়স্তানে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের উপর হামলার নেপথ্যে রয়েছে একটি ভিডিয়ো। গত ১৩ মে যা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিয়োটি দেখার পর থেকে কিরঘিজ়স্তানে পড়তে যাওয়া বিদেশি পড়ুয়াদের উপর সে দেশের তরুণ প্রজন্ম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
ভাইরাল ভিডিয়োয় স্থানীয় কিরঘিজ় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কিছু বিদেশি পড়ুয়াকে বচসা করতে দেখা গিয়েছিল। বিদেশিদের মধ্যে অবশ্য ভারতীয় কেউ ছিলেন না। মূলত পাকিস্তানি এবং মিশরীয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বচসা হয়েছিল কিরঘিজ়দের। ভাইরাল ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।
এই ভিডিয়ো ঘিরে কিরঘিজ়স্তানের রাজধানীর বিশকেকে উত্তেজনা তৈরি হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, সেখানকার প্রশাসন বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি একটু বেশিই নরম মনোভাবাপন্ন। তাই তাঁদের ‘শিক্ষা’ দিতে তাঁরা নিজেরাই পথে নামেন।
বিশকেকের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, হস্টেল, মেসগুলি ঘিরে ফেলেন কিরঘিজ়রা। বিদেশি পড়ুয়াদের চিহ্নিত করে শুরু হয় মারধর। মূলত এই আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পড়ুয়ারা। আক্রান্ত হন পাকিস্তানি, বাংলাদেশি এবং ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা।
বিশকেকের পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে ১৮ মে সকালে তড়িঘড়ি বিবৃতি জারি করে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। সেখানকার ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের যতটা সম্ভব ঘরের ভিতর থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোতে নিষেধ করা হয়।
বিদেশ মন্ত্রক আরও জানায়, তারা বিশকেকের পরিস্থিতির উপর নজর রেখেছে। সে দেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গেও পড়ুয়াদের যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। ১৮ মে বিশকেকের ভারতীয় দূতাবাস জানায়, পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’।
প্রায় একই ধরনের বিবৃতি দেয় পাকিস্তান এবং বাংলাদেশও। তারাও নিজ দেশের ছাত্রছাত্রীদের সাবধানে এবং যতটা সম্ভব ঘরের ভিতর থাকার পরামর্শ দেয়। জানায়, দূতাবাস এই পরিস্থিতির দিকে নজর রেখেছে।
কিরঘিজ়স্তানের পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক গুজব ছড়ায় সমাজমাধ্যমে। কেউ কেউ বলতে আরম্ভ করেন কিরঘিজ়স্তানে স্থানীয়দের আক্রমণে তিন পাকিস্তানি পড়ুয়ার মৃত্যু হয়েছে। তবে সেই গুজব উড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। বিশকেকের পুলিশ জানিয়েছে, ১৭ মে রাতের ঘটনায় বেশ কয়েক জন স্থানীয় যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রশ্ন হল, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার মতো নামী এবং উন্নত দেশ ছেড়ে কেন মধ্য এশিয়ার এই তুলনামূলক অখ্যাত দেশে ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার পড়ুয়া ডাক্তারি পড়তে যান? কী আছে কিরঘিজ়স্তানে?
উত্তর একটাই, সাশ্রয়। কিরঘিজ়স্তানে অনেক কম খরচে ডাক্তারি পড়া যায়। সেই এমবিবিএস ডিগ্রি আমেরিকা বা ব্রিটেনের ডিগ্রির চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। কারণ, সেই ডিগ্রিকে মান্যতা দেয় খোদ রাষ্ট্রপুঞ্জ।
পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজার ভারতীয়, ১১ হাজারের বেশি পাকিস্তানি এবং হাজারের বেশি বাংলাদেশি পড়ুয়া উচ্চ শিক্ষার সূত্রে কিরঘিজ়স্তানে রয়েছেন।
কিরঘিজ়স্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ডাক্তারি পড়তে ছ’বছরে তিন থেকে পাঁচ হাজার আমেরিকান ডলার খরচ হয়ে থাকে। ভারতীয় মুদ্রায় যার মূল্য আড়াই থেকে চার লক্ষ টাকা।
ভারত বা পশ্চিমের দেশগুলিতে এই ছ’বছরের কোর্সের খরচ আরও অনেক বেশি। সস্তায় এমবিবিএস ডিগ্রি লাভের আশায় তাই ভারত তথা উপমহাদেশের পড়ুয়ারা কিরঘিজ়স্তানে ভিড় করেন।
সস্তায় ডাক্তারি পড়ার জন্য ভারতীয় পড়ুয়াদের আরও একটি জনপ্রিয় ঠিকানা ছিল ইউক্রেন। কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করা পর থেকে এখনও পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ চলছে। তাই সেখান থেকে ফিরে এসেছেন বহু পড়ুয়া।
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কিরঘিজ়স্তানে ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের ভিড় আরও বেড়ে গিয়েছে। তবে সেই ‘নির্ভরযোগ্য’ দেশেই এ বার আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে বিদেশি পড়ুয়াদের। পরিস্থিতি আপাত ভাবে সামাল দেওয়া গেলেও যা নিয়ে চিন্তায় নয়াদিল্লি।