মণিপুরে অশান্তি নিয়ে গত বছর থেকে টানা শিরোনামে থেকেছে উত্তর-পূর্ব ভারত। মেইতেই এবং কুকিদের অশান্তির আঁচ মণিপুরের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাকি রাজ্যগুলিতেও।
মণিপুরে অশান্তির প্রভাবে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে নাগাল্যান্ড, মিজ়োরামেও। এই পরিস্থিতিতে উত্তর-পূর্ব ভারতে শান্তি ফেরাতে, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। যা হিতে বিপরীত ডেকে এনেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
অশান্তির আবহে গত ফেব্রুয়ারিতে মায়ানমারের সঙ্গে ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিমে’ (এফএমআর) বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাতে নতুন করে অশান্তি তৈরি হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা।
‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিমে’ বা এফএমআর কী? কেনই বা তা বন্ধ হতে দিতে চান না উত্তর-পূর্ব ভারতের অধিকাংশ বাসিন্দা? আর দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে কেন বন্ধ করা জরুরি বলে মনে করেছে সরকার?
আর পাঁচটা দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এবং মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের সীমান্তের সমীকরণ এক নয়। মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের সীমান্তের বেশ খানিকটা অংশে কোনও কাঁটাতার নেই। দুই দেশের নাগরিকেরা সেখানে অবাধে যাতায়াত করতে পারেন। তাকেই বলে এফএমআর।
মায়ানমারের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের রাজ্যগুলি হল নাগাল্যান্ড, মণিপুর এবং মিজ়োরাম। মায়ানমার সীমান্তের মোট দৈর্ঘ্য ১,৬৪৩ কিলোমিটার। এফএমআর অনুযায়ী, এর মধ্যে ১৬ কিলোমিটার অংশে কাঁটাতার দেওয়া নেই। দুই দেশের মধ্যে এই ১৬ কিলোমিটারের সীমান্ত খোলা।
কুকি, নাগা, জো সম্প্রদায়ের সঙ্গে মায়ানমারের চিন সম্প্রদায়ের মানুষের সংযোগ রয়েছে। তাঁদের রীতিনীতি, সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। তাই এই চিন সম্প্রদায়ের সঙ্গে আত্মিক যোগ অনুভব করেন উত্তর-পূর্বের একটা বড় অংশের মানুষ।
প্রাচীনকাল থেকেই মায়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে ভারতের সীমান্তলাগোয়া সম্প্রদায়গুলির আদানপ্রদানের সম্পর্ক বিদ্যমান। দুই দেশের মাঝে সীমারেখা টেনে দেওয়া হলেও যা বন্ধ হয়নি।
ভারত এবং মায়ানমারের মধ্যের ওই ১৬ কিলোমিটার খোলা সীমান্ত দিয়ে দুই দেশের মানুষের মধ্যে ভাব বিনিময় হয়ে থাকে। স্থানীয় বাণিজ্যও চলে অবাধে। আর এতেই বাদ সেধেছে ভারত সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত।
মণিপুরে অশান্তির আবহে মায়ানমার সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। এর মাধ্যমে সীমান্তের ওপার থেকে অনুপ্রবেশ আটকানোই সরকারের উদ্দেশ্য।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সেনা শাসনের অধীনে মায়ানমার। অর্থাৎ, সেখানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার নেই। তাই দীর্ঘ তিন বছর ধরে ভারতের এই পড়শি দেশের অভ্যন্তরে অশান্তি লেগেই আছে।
গণতান্ত্রিক শাসন চেয়ে মায়ানমারের যে ‘বিদ্রোহী’রা দেশের অন্দরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তাঁদের সংস্পর্শে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও বিক্ষোভের আঁচ পুঞ্জীভূত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অভিযোগ, মায়ানমার থেকে সশস্ত্র ‘বিদ্রোহী’রা অনেকেই গত কয়েক মাসে ভারতে ঢুকে পড়েছেন। ভারতেই আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। এমনকি, উত্তর-পূর্বে অশান্তির নেপথ্যেও তাঁদের কেউ কেউ রয়েছেন বলে অভিযোগ।
অশান্তি ঠেকাতে এবং দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে তাই সীমান্ত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি তাতে সায় দেয়নি। প্রকাশ্যেই কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে অবস্থান স্পষ্ট করেছে নাগাল্যান্ড, মিজ়োরামের মতো রাজ্যগুলি।
উত্তর-পূর্বে শান্তি ফেরাতে এফএমআর তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই সিদ্ধান্তে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এফএমআর-কে কেন্দ্র করে আরও জটিল হয়ে উঠছে উত্তর-পূর্বের রাজনীতি।