মধ্যপ্রদেশে গদি আগেই উল্টেছিল। এ বার রাজস্থান এবং ছত্তীসগঢ়েও কংগ্রেসের গদি ওল্টানোর পথে। ছত্তীসগঢ়ে ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে সরকার গঠনের জন্য দরকার ছিল ৪৬টি আসনের। বিকেল ৩টের হিসাব অনুযায়ী, এর মধ্যে ৫৫টি আসনে এগিয়ে নিরঙ্কুশ জয়ের পথে বিজেপি। কংগ্রেস এগিয়ে ৩২টি আসনে। বিএসপি ১টি এবং অন্যান্য ২টি আসনে এগিয়ে।
কেন ছত্তীসগঢ়ে ধরাশায়ী হল কংগ্রেস? ছত্তীসগঢ়ের হাওয়ায় ভাসছে, ‘মহাদেবের কোপে’ই গদিচ্যুত হতে হল মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বঘেলকে।
গত ৭ নভেম্বর প্রথম দফায় মাওবাদী উপদ্রুত ২০টি আসনে ভোট হয়েছিল। বাকি ৭০টিতে হয়েছিল ১৭ নভেম্বর। কিন্তু সেই নির্বাচনের ঠিক আগেই পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ ওঠে মুখ্যমন্ত্রী বঘেলের বিরুদ্ধে।
গত ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ইডি দাবি করে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভিলাই থেকে অসীম দাস নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে তারা। ইডির অভিযোগ ছিল, কংগ্রেসের নির্বাচনের খরচ জোগাতে ওই ব্যক্তিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে পাঠিয়েছিলেন ‘মহাদেব’ অ্যাপের মালিকেরা।
ইডি-র দাবি ছিল, ‘বঘেল’ নামে এক রাজনীতিককে দেওয়ার জন্য অসীম পাঁচ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা নিয়ে এসেছিলেন দুবাইয়ে আশ্রয় নেওয়া ‘মহাদেব অ্যাপ’-এর মালিকের কাছ থেকে। এর পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভোটপ্রচারে ছত্তীসগঢ়ে গিয়ে নিশানা করেন বঘেলকে।
পরবর্তী কালে ‘মহাদেব বেটিং অ্যাপ’-এর মালিক শুভম সোনি সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে একটি ভিডিয়োবার্তায় (যার সত্যতা আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি) বঘেলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা স্বীকার করেন। দাবি করেন, বঘেলই তাঁকে দুবাই যেতে ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন। শুভমের সেই দাবির পর সুর আরও চড়ে বিজেপির। ভোটের আগে বিজেপির প্রায় প্রতিটি জনসভাতেই ‘মহাদেব’কে হাতিয়ার বানিয়ে প্রচার চালাতে দেখা দিয়েছিল গেরুয়া শিবিরকে।
ভোটের বাজারে কংগ্রেসের অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে ‘মহাদেব’। যদিও বঘেল সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বরং কংগ্রেসের দখলে থাকা ছত্তীসগঢ় এবং রাজস্থানে কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি-র ‘অতি সক্রিয়তা’ নিয়ে মোদী সরকারকে বিঁধেছিলেন তিনি।
নির্বাচনের আগে বিজেপির মোকাবিলায় দেদার জনমোহিনী সরকারি প্রকল্প এবং অঙ্গীকারের কথাও শুনিয়েছিলেন বঘেল। ‘অস্ত্র’ হিসাবে ছিল কৃষিঋণ মকুব, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, ধানের দাম কুইন্টাল প্রতি ৩২০০ টাকা করা, একর প্রতি ২০ কুইন্টাল ধান কেনা, গ্যাসের সিলিন্ডারে ৫০০ টাকা ভর্তুকির মতো প্রতিশ্রুতির তালিকা।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের অনুকরণে মহিলাদের মাসে ১৫ হাজার টাকা আর্থিক অনুদানের কথাও ঘোষণা করেছিলেন বঘেল। পাশাপাশি বঘেলের প্রচারে বার বার উঠে এসেছিল ছত্তীসগঢ়ে কৃষকদের ঋণ মকুবের ক্ষেত্রে কংগ্রেস সরকারের ভূমিকা।
তবে রবিবার ভোটগণনার সময় বোঝা গেল, কোনও অস্ত্রেই সে ভাবে শান দিতে পারেননি বঘেল। নইলে কি ছত্তীসগঢ়ে এ ভাবে ধরাশায়ী হত কংগ্রেস!
শুধু ‘মহাদেব’ না, ছত্তীসগঢ়ে ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে কংগ্রেস সরকারের ‘পথের কাঁটা’ ছিল আরও। তার মধ্যে অন্যতম, মাওবাদী দমনে কংগ্রেসি ‘নিষ্ক্রিয়তা’।
বিজেপি বার বার অভিযোগ করেছে, কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলেই দেশে সন্ত্রাসবাদী ও মাওবাদীদের কার্যকলাপ বেড়ে যায়। নির্বাচনের আগে ছত্তীসগঢ়ের সেই মাওবাদী ‘ইস্যু’কে হাতিয়ার করেছিল বিজেপি।
কংগ্রেস সরকার ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদীদের দমনে ব্যর্থ হয়েছে বলে বার বার অভিযোগ করেছে বিজেপি। সে রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে এসে সেই অভিযোগেই ধার দিতে দেখা গিয়েছিল মোদীকে। সুরগুজায় প্রচারে এসে মোদী বলেন, ‘‘যখনই কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে, দেশে সন্ত্রাসবাদী ও মাওবাদীদের সাহস বেড়ে যায়। কংগ্রেস সরকার নকশালদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বিজেপি কর্মীকে খুন করা হয়েছে।’’
এর পর ৭ নভেম্বর মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ফরমান উড়িয়ে উপদ্রুত আসনগুলির ভোটের লাইনে শামিল হয় ছত্তীসগঢ়। তবে মাওবাদী হামলা ঠেকানো যায়নি। ভোটগ্রহণের দিনই বিক্ষিপ্ত হিংসা ঘটে ছত্তীসগঢ়ে। সুকমায় সিবিআই (মাওবাদী) গেরিলা বাহিনীর আইইডি বিস্ফোরণে কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জওয়ান আহত হন। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মাওবাদীদের গুলির লড়াই হয় কাঁকেরে।
দুই দফার ভোট মিটে যাওয়ার পরও মাওবাদীদের কার্যকলাপ দেখা যায় ছত্তীসগঢ়ে। গত ২৪ নভেম্বর নারায়ণপুর জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা চালানোর জন্য ইমপ্রোভাইজ়ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) পুঁতে রেখেছিলেন মাওবাদীরা। সেই আইইডি বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় দুই খনি শ্রমিকের।
মাওবাদী উপদ্রুত সেই ২০টি আসনের বেশির ভাগেই জয়ের মুখ দেখেছে বিজেপি। এমনকি, কংগ্রেস নেতৃত্বের ‘জনমুখী’ প্রস্তাবও মাওবাদী এলাকায় খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি।
সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কলেজ স্তর পর্যন্ত বিনাখরচায় পড়াশোনা এবং কেন্দুপাতার বস্তা-প্রতি সরকারি মূল্য ৬০০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতির সুফলও জনজাতি ভোটে বঘেল পাননি বলে মনে করছেন ভোট পণ্ডিতদের একাংশ। একই সঙ্গে, মাওবাদী উপদ্রুত এলাকাগুলির অনুন্নয়নও কংগ্রেসের ক্ষমতা ধরে রাখার পথে পরিপন্থী হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
দীর্ঘ দিন ধরেই সঙ্ঘ পরিবার ধর্মান্তরণ ঠেকাতে জাতীয় স্তরে কড়া আইনের দাবিতে সরব। নির্বাচনের আগে ছত্তীসগঢ়ে ধর্মান্তরণের অভিযোগ তুলে সরব হতে দেখা গিয়েছিল বিজেপিকে। বিজেপির অভিযোগ ছিল, ছত্তীসগঢ়ের আদিবাসীদের জোর করে এবং প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরণের চেষ্টা চলছে ধারাবাহিক ভাবে। তা বন্ধ করতে কংগ্রেস সরকার কোনও সক্রিয়তা দেখাচ্ছে না।
প্রচারে এসে ছত্তীসগঢ়ে ধর্মান্তরণ নিয়ে সরব হতে দেখা গিয়েছিল কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা রাজনাথ সিংহকে। তাঁর অভিযোগ ছিল, গত পাঁচ বছরে কংগ্রেস সরকারের জমানায় ছত্তীসগঢ়ে আদিবাসীদের ধর্মান্তরণ এবং মাওবাদী উপদ্রব বেড়েছে। বিজেপি ক্ষমতায় এলে ধর্মান্তরণ রুখতে বিজেপির ‘কড়া দাওয়াই’ দেওয়ার কথাও তিনি জানিয়েছিলেন! সেই ‘দাওয়াই’ ছত্তীসগঢ়ে বিজেপির পক্ষে গিয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন।
এক সময় সামাজিক ভাবে অস্পৃশ্য দলিতদের নিয়ে সতনামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রয়াত গুরু ঘাসীদাস। সেই সতনামী সমাজের হাতে রাজ্যের ১৬ শতাংশ ভোট। অন্তত এক ডজন আসনে সতনামী ভোটাররাই ছিলেন নির্ণায়ক শক্তি।
২০১৮ সালে সেই সমাজের নেতা প্রকাশ্যে কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিলেন। যা রমন সরকারের পতনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়ে। এ বার সতনামী গুরুর সমর্থন ছিল পদ্মশিবিরের দিকে।
‘জনতা কংগ্রেস ছত্তীসগঢ়’-এর পাশাপাশি প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রভাবশালী আদিবাসী নেতা অরবিন্দ নেতমের নতুন দল ‘হামার রাজ পার্টি’ এবং মূলত আদিবাসী খ্রিস্টানদের সংগঠন ‘সর্ব আদি দল’ও কংগ্রেসের ভোটে কিছুটা ভাগ বসিয়ে বিজেপির সুবিধা করে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটে দেড় দশকের বিজেপি শাসনের ইতি ঘটিয়ে প্রথম বার বিধানসভা ভোটে জিতে ছত্তীসগঢ়ে ক্ষমতা দখল করেছিল কংগ্রেস। রাজ্যের ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬৮টি জিতেছিল তারা। বিজেপি ১৫টিতে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজিত যোগীর দল ‘জনতা কংগ্রেস ছত্তীসগঢ়’ (জেসিসি) পাঁচটি এবং তার সহযোগী বিএসপি দু’টি বিধানসভা আসনে জয়ী হয়েছিল। সরকার গঠন করেছিল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ভূপেশ।
তবে পাঁচ বছরেই হিসাব ঘুরে গেল। জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাস ছিল, মুখ্যমন্ত্রী বঘেলের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের নেতৃত্বাধীন বিজেপির চেয়ে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। জনমত সমীক্ষার অনেক পূর্বাভাসের মতো সেই পূর্বাভাসও মিলল না।