১৯৯৯-এর মে মাসে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে মুশকো, দ্রাস, কাকসার এবং বাটালিক সেক্টর, কার্গিল সেক্টরে ঢুকে পড়েছিল পাক হানাদারেরা। তাদের সরিয়ে দিতে অভিযানে নামে ভারতীয় সেনা। সেই অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন বিজয়’।
৩ মে থেকে শুরু করে ২৬ জুলাই পর্যন্ত চলেছিল কার্গিলের যুদ্ধ। প্রায় তিন মাস ধরে। ২০২৪ সালে সেই ‘অপারেশন বিজয়’-এর ২৫ বছর পূর্তি।
কার্গিল যুদ্ধে ৫০০ জনেরও বেশি ভারতীয় জওয়ান শহিদ হয়েছিলেন। দুই দেশের সম্পর্ক সে সময় ভিন্ন এক মাত্রায় পৌঁছেছিল।
১৯৯৯ সালের মে থেকে জুলাই জম্মু এবং কাশ্মীরের দ্রাস-কার্গিল সেক্টরে চলে লড়াই। পাকিস্তানের দিক থেকে নাগাড়ে অনুপ্রবেশ চলতে থাকে কার্গিলে। পাকিস্তান প্রথমে দাবি করে যে, জঙ্গিরাই এ সব করছে। পরে যদিও তাঁর আত্মজীবনী ‘ইন দ্য লাইফ অব ফায়ার’-এ পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ় মুশারফ স্বীকার করেছিলেন, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে ছিল পাক সেনাও।
মনে করা হয়, মুশারফ ভেবেছিলেন দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ যুদ্ধ করছে দেখে হস্তক্ষেপ করবে আমেরিকা-সহ আন্তর্জাতিক মহল। তাতে লাভের ধন আসবে পাকিস্তানেরই ঘরে। কাশ্মীরের ভূখণ্ড চলে আসবে তাদের দখলে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলকে কিছু করতে হয়নি। তার আগেই পাক সেনাবাহিনীকে শায়েস্তা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সালের ২৬ জুলাই বিজয় ঘোষণা করে ভারত।
ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ই পরমাণু অস্ত্রধর দেশ হলেও কার্গিল যুদ্ধ লড়েছিল পরমাণু অস্ত্র ছাড়া। উভয় পক্ষই প্রায় সব ধরনের প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করেছিল সেই যুদ্ধে। ভারত বিমানবাহিনীও মোতায়েন করেছিল।
কিন্তু পাকিস্তান সেই যুদ্ধে বিমানবাহিনী মোতায়েন করতে পারেনি। কারণ, প্রাথমিক ভাবে ইসলামাবাদ কার্গিল যুদ্ধে তাদের কোনও ভূমিকা থাকার কথা অস্বীকার করেছিল। পাকিস্তানের দাবি ছিল, জঙ্গি সংগঠন কাশ্মীর মুজাহিদিনের তরফে হামলা চালানো হচ্ছে।
তবে পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফ এবং সেনাপ্রধান মুশারফের বিবৃতিতে পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনীর সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
কার্গিল যুদ্ধের সময় ভারত এবং পাকিস্তান— উভয় পক্ষের কাছেই পরমাণু অস্ত্র ছিল। কিন্তু কার্গিল যুদ্ধে কেউই পারমাণবিক শক্তি প্রদর্শন করেনি। যদিও যুদ্ধ চলাকালীন আন্তর্জাতিক মহলে গুঞ্জন ওঠে, একে অপরের দিকে পরমাণু হামলা চালাতে পারে দুই শক্তিধর দেশ।
পাক সংবাদমাধ্যম নিউজ় অফ পাকিস্তান ১৯৯৯ সালের ৩১ মে পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের সচিব শামশাদ আহমেদকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে লিখেছিল, ‘‘যুদ্ধে জিততে অস্ত্রাগারে থাকা যে কোনও অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে পাকিস্তান।’’ এর পরেই পরমাণু হামলা চালানোর জল্পনা আরও তীব্র হয়।
আন্তর্জাতিক মহলে এ-ও কানাঘুষো শুরু হয়েছিল যে, কার্গিল যুদ্ধে ভারতের উপর পরমাণু হামলা চালাতে বদ্ধপরিকর পাকিস্তান।
ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব ভয়ঙ্কর মোড় নেয়, যখন আমেরিকার গোয়েন্দা সূত্রে খবর আসে যে, পাকিস্তান তার পরমাণু অস্ত্রগুলি ভারত সীমান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নাকি নওয়াজ়কে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন বলে জানা গিয়েছিল।
হোয়াইট হাউসের তৎকালীন এক কর্মকর্তা পরবর্তীকালে জানান যে, পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় মনে করেছিলেন, ভারতও তাদের উপর পরমাণু হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে আমেরিকার হস্তক্ষেপে নাকি পিছিয়ে এসেছিলেন নওয়াজ়।
তবে ভারতও যে পাক হামলার জবাব দিতে তৈরি ছিল, তা পরে জানা যায়। ২০০০ সালে একটি প্রতিরক্ষা বিষয়ক পত্রিকা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় বদ্রি-মহারাজকে উদ্ধৃত করে জানায়, ভারতও সেই সময় অন্তত পাঁচটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিজেদের হাতে মজুত রেখেছিল।
তবে কার্গিল যুদ্ধে আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও দুই দেশের প্রতিবেশী চিন এই যুদ্ধে ‘নাক গলানো’ থেকে বিরত রেখেছিল।
কার্গিলের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অবস্থা যখন টলমল, তখন আমেরিকার কাছে সাহায্য চেয়েছিল পাকিস্তান। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সহযোগী ব্রুস রিডেলের দাবি, বৃহত্তর সংঘাত এড়াতে পাকিস্তানকে সাহায্য করতে রাজি হয়নি আমেরিকা। আমেরিকার দাবি ছিল, ভারত থেকে পাকিস্তান সৈন্য প্রত্যাহার না করলে তারা কোনও ভাবেই সাহায্য করবে না।
১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই ওয়াশিংটন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল আমেরিকা এবং পাকিস্তানের মধ্যে। পাকিস্তান সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজি হওয়ায় ধীরে ধীরে বেশির ভাগ জায়গায় কার্গিল যুদ্ধ থেমে যায়। যদিও কিছু পাক সেনা লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ভারত বিমানবাহিনী নিয়ে আক্রমণ শুরু করে। ২৬ জুলাই দ্রাস এলাকা থেকে পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনী। ভারত ২৬ জুলাইকে ‘বিজয় দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে।
তবে প্রায় তিন মাস ধরেই কার্গিল যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল চিন। ভারত এবং পাকিস্তান— উভয়েই চিনের প্রতিবেশী। তা সত্ত্বেও কেন প্রতিবেশীদের যুদ্ধ থামাতে উদ্যত হয়নি বেজিং?
প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে কার্গিল সংঘাতের বিষয়ে চিনের দৃষ্টিভঙ্গি ভারত এবং পাকিস্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চিনের দাবি ছিল, দুই দেশের সামরিক সংঘাতে কোনও সমস্যার সমাধান হবে না। উল্টে ভারত-পাক যুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
চিনের পরামর্শ ছিল, উভয় পক্ষের সেনাদের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর নিজেদের অবস্থানে ফিরে যাওয়া উচিত এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে যুদ্ধের নিষ্পত্তি ঘটনো উচিত। ভারত এবং পাকিস্তান— উভয়কেই সংযম দেখানোর ‘পরামর্শ’ও দিয়েছিল চিন।
যদিও মনে করা হয়, বেজিং নিজেই জিনজিয়াংয়ের ইসলামি আন্দোলনকে দমন করা এবং কমিউনিস্ট দেশের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা উইঘুর মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিল সেই সময়ে। আর সে কারণেই তারা পাকিস্তানের পক্ষ নেয়নি।
এ-ও মনে করা হয়, আন্তর্জাতিক সমীকরণের কথা মাথায় রেখে এবং কার্গিল যুদ্ধে ‘বন্ধু’ আমেরিকার জড়িয়ে পড়ার কারণেই যুদ্ধের বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হয়নি তারা।