নেপালের পর্বতময় প্রদেশে তাঁদের বাস। পাহাড়ি আবহাওয়া, প্রতিকূল পরিস্থিতি, দুর্গম পথ হাতের তালুর মতো তাঁদের চেনা। এই দুর্গমতা আর প্রতিকূলতাই গোর্খাদের দুর্ধর্ষ করে তুলেছে।
নেপালের পার্বত্য এলাকার দুঃসাহসিক যোদ্ধাদের নাম গোর্খা। যুদ্ধই তাঁদের পেশা। বছরের পর বছর ধরে তাঁরা নিজস্ব প্রাচীন পন্থায় যুদ্ধ করে আসছেন। শুধু নেপাল নয়, অন্য দেশে যুদ্ধের জন্যও গোর্খাদের ডাক পড়ে।
সম্প্রতি নেপালি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কিছু প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দলে দলে নেপালি যুবক রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন। নেপালের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে তরুণ গোর্খারা নাকি রাশিয়ায় যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন।
ইউক্রেন আক্রমণের পর সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিদেশি যোদ্ধাদের আহ্বান জানান। বলা হয়, রাশিয়ার হয়ে এক বছর যুদ্ধ করলে বিদেশি সৈনিকেরা সপরিবারে রাশিয়ার স্থায়ী নাগরিকত্ব পাবেন।
নাগরিকত্বের লোভেই নাকি দলে দলে নেপালি যুবক রাশিয়ায় চলে যাচ্ছেন। রাশিয়ার সেনায় বেতনের পরিকাঠামোও তাঁদের কাছে লোভনীয় ঠেকছে বলে দাবি করা হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে রাশিয়ান হিসাবে নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি।
ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের তুরুপের তাস কি তবে এই নেপালিরাই? গোর্খাদের যুদ্ধের প্রাচীন ইতিহাসে আস্থা রেখে পুতিন তাঁদের দলে টানছেন। মনে করা হচ্ছে, আগামী দিনে অন্য বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধেও এই যোদ্ধাদের কাজে লাগাতে পারেন তিনি।
তবে নেপালের এই গোর্খারা রাশিয়া নয়, ব্রিটিশদের ‘আবিষ্কার’। উনিশ শতকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নেপাল আক্রমণ করেছিল। নেপালের সঙ্গে যুদ্ধে বহু প্রাণহানি হয়েছিল ব্রিটিশদের। বাধ্য হয়ে ১৮১৫ সালে নেপালের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি যুদ্ধবিরতি এবং শান্তি চুক্তি স্থাপন করে।
এই চুক্তির শর্তেই বলা ছিল, নেপাল থেকে গোর্খা যোদ্ধাদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করতে পারবে ব্রিটেন। প্রথমে ব্রিটিশ ভারতের সেনায় গোর্খা রেজিমেন্ট ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর তা ব্রিটিশ সেনার অন্তর্ভুক্ত হয়।
আজও ব্রিটেনের সেনার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এই গোর্খারা। নেপাল থেকেই তাঁদের নিয়োগ করা হয়। ব্রিটেনে থেকে ব্রিটেনের হয়ে তাঁরা যুদ্ধ করেন। অবসরের পর আবার ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে।
ব্রিটেনের হয়ে যুদ্ধ করলেও গোর্খারা সে দেশের নাগরিকত্ব পান না। এমনকি, তাঁদের বেতন কাঠামো, পেনশন সাধারণ ব্রিটিশ সেনার তুলনায় কম। বেতন এবং পেনশনের বিবিধ দাবিতে দীর্ঘ দিন লড়াই চালাচ্ছেন নেপালি গোর্খারা।
বিশ্বের অন্যতম দুর্ধর্ষ যোদ্ধা এই গোর্খাবাহিনী। ঐতিহ্য বহন করতে আজও তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের সঙ্গে রাখেন ১৮ ইঞ্চি লম্বা বাঁকা ছুরি বা কুকরি।
গোর্খাদের যুদ্ধের অন্যতম অঙ্গ এই কুকরি। তবে তারা আধুনিক পদ্ধতিতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহার করে থাকেন। কুকরি নিয়ে গোর্খাদের মধ্যে নানা প্রাচীন প্রথার চল রয়েছে।
বলা হয়, ধারালো কুকরি আসলে ‘রক্তপিপাসু’। এক বার কুকরি নিয়ে যুদ্ধে বেরোলে তাতে রক্ত না লাগিয়ে ফেরা যায় না। যদি যুদ্ধে ওই কুকরি দিয়ে কাউকে না-ও মারা হয়, তবে কুকরির মালিক নিজের শরীরের কোনও অংশ কেটে অস্ত্রে রক্ত লাগান।
বর্তমানে এই প্রথা অনেকেই মানেন না। গোর্খারা বলেন, আজকাল কুকরি গোর্খাদের ঘরে রান্নার কাজেও ব্যবহার করা হয়। তবে রয়ে গিয়েছে তার প্রাচীন তেজ। গোর্খারা বলেন, ‘‘কাপুরুষ হওয়ার চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেওয়া অনেক বেশি গর্বের।’’
ব্রিটেনের অধীনস্ত গোর্খারা ইরাক এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, বোর্নিয়ো, সাইপ্রাসের মতো দেশেও তাঁদের যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়।
অত্যন্ত কঠিন নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গুটিকয়েক গোর্খা ব্রিটিশ সেনায় সুযোগ পান। পাহাড়ি রাস্তায় চড়াই বরাবর টানা ৪০ মিনিট দৌড়তে বলা হয় নেপালি তরুণদের। তাঁদের পিঠে থাকে পাথরভর্তি ৩১ কেজির ব্যাগ।
রাশিয়ান নাগরিকত্বের হাতছানিতে এই গোর্খাদের অনেকেই পুতিনের সেনায় যোগ দিচ্ছেন বলে খবর নেপালি সংবাদমাধ্যম সূত্রে। যদিও রাশিয়ায় অবস্থিত নেপালি দূতাবাসের কাছে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই সংক্রান্ত খবর নেই।
রাশিয়ার সেনায় যোগ দিতে গেলে ভাষার বাধা একটি বড় সমস্যা হয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু তা-ও হয়নি। নেপালি তরুণেরা জানিয়েছেন, প্রথম দিকে রাশিয়ান ভাষা শিখতে বলা হলেও পরে সেই নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। বর্তমানে শুধু ইংরেজি জানলেই রাশিয়ান সেনায় যোগ দেওয়া যায়।