সুতোয় টান পড়তেই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে উঠে আসছে একের পর এক নাম। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে শুরু হয়েছিল। নিয়োগ দুর্নীতিতে সর্বশেষে যাঁর নাম জড়াল, তিনি হৈমন্তী গঙ্গোপাধ্যায়। ধৃত তৃণমূল যুবনেতা কুন্তল ঘোষ দাবি করেছেন, এই হৈমন্তী গোপাল দলপতির স্ত্রী। সত্যিই কি তাই? যদি তা হয়েই থাকেন, তবে কোথায় হৈমন্তী? গোপালই বা কোথায়? সব সংবাদমাধ্যম হন্যে হয়ে তাঁদের খোঁজার চেষ্টা করছে। যদিও তাঁদের খোঁজ এখনও মেলেনি।
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন হুগলির যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল। কুন্তল অভিযোগ করেছিলেন, নিয়োগ দুর্নীতির ‘আসল লোক’ হলেন গোপাল দলপতি। তাঁর বিরুদ্ধে টাকা লেনদেনেরও অভিযোগ করেছিলেন কুন্তল।
এই গোপাল আবার মানিক ভট্টাচার্যের ‘ঘনিষ্ঠ’ এবং বেসরকারি ডিএলএড কলেজ সংগঠনের সভাপতি তাপস মণ্ডলের ‘পরিচিত’। তদন্তে নেমে সিবিআই জানতে পেরেছিল, অতীতে চিটফান্ড কাণ্ডে নাম জড়িয়েছিল গোপালের। দিল্লির তিহাড় জেলে বন্দিও ছিলেন তিনি। এর পর সিবিআইয়ের দফতরে হাজিরাও দিয়েছিলেন গোপাল। যদিও এখন কোথায়, সেই নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়েছে। হৈমন্তীর নাম প্রকাশ্যে আসতেই নিজেকে আড়ালে রেখেছেন গোপাল। সংবাদমাধ্যম চেষ্টা করেও তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।
সিবিআইয়ের জেরায় কুন্তল দাবি করেছেন, গোপালেরই স্ত্রী হৈমন্তী। কুন্তলের বয়ান অনুযায়ী, হৈমন্তীর কাছেই রয়েছে সব টাকা। কোন টাকা? হৈমন্তীর কাছে কি তবে নিয়োগ দুর্নীতির টাকা রয়েছে? তা অবশ্য খোলসা করেননি কুন্তল। তার পর থেকেই শুরু হয়েছে কানাঘুষো। প্রশ্ন উঠছে, হৈমন্তীর আসল পরিচয় নিয়ে।
জানা গিয়েছে, হাওড়ার বাকসাড়ায় পৈতৃক বাড়ি রয়েছে হৈমন্তীর। টালিগঞ্জে তাঁর একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, হৈমন্তী পেশায় মডেল।
হৈমন্তীরই এক ঘনিষ্ঠ জানিয়েছেন, তিনি গোপালের দ্বিতীয় স্ত্রী। যদিও নিয়োগ দুর্নীতিতে নাম জড়ানোর পর হৈমন্তীর মা জানিয়েছেন, তিনি মেয়ের বিষয়ে কিছুই জানেন না। তাঁর মেয়ে ‘মারা গিয়েছে’।
হৈমন্তীর বিষয়ে জানতে তাঁর হাওড়ার বাড়িতে গিয়েছিলেন আনন্দবাজার অনলাইনের প্রতিবেদক। হৈমন্তীর মা জানিয়েছেন, ১০-১৫ দিন আগে এক বার এসেছিলেন তিনি। তবে মেয়ের গতিবিধি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেন না তিনি।
হৈমন্তীর কবে বিয়ে হয়েছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি তাঁর মা। আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন, কবে বিয়ে হয়েছে, তিনি জানেন না। বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। হৈমন্তী অনেক কিছুই করতেন। তবে সে বিষয়ে তাঁরা কিছু জানেন না। ভালবেসে নিজেই বিয়ে করেছিলেন। আগে বাড়ি আসতেন। এখন আর কেউ আসেন না।
সূত্রের দাবি, হৈমন্তীর নামে একটি সংস্থা রয়েছে। নাম ‘হৈমন্তী অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড’। সংস্থার দফতর কলকাতার বিবাদী বাগে। ২০১৩ সাল থেকে ওই সংস্থার ডিরেক্টর পদে নাম রয়েছে হৈমন্তী এবং আরমান গঙ্গোপাধ্যায়ের। কুন্তল দাবি করেছিলেন, গোপাল দলপতিরই আর এক নাম আরমান।
সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, মুম্বইয়ের একটি সংস্থার সঙ্গেও যোগ রয়েছে আরমান এবং হৈমন্তীর। ২০১৭ সাল থেকে ওই সংস্থার সঙ্গে যোগ রয়েছে তাঁদের। আরমানের অ্যাকাউন্ট থেকে ওই সংস্থায় লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন হয়েছে। সেখানেও হৈমন্তীর যোগ মিলেছে।
তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে আরমানের নামে একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। যে নথি হাতে এসেছে, তাতে দেখা গিয়েছে, ওই অ্যাকাউন্টে ‘নমিনি’ হিসাবে নাম রয়েছে হৈমন্তীর।
হৈমন্তীর কথা প্রকাশ্যে আসতেই গোপালকে ফোন করা হয়েছিল। যদিও তিনি এই নিয়ে মুখ খুলতে চাননি।
হৈমন্তীর সঙ্গেও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি কি গোপালের স্ত্রী? গোপালের অ্যাকাউন্টে ‘নমিনি’ হিসাবে কি তাঁর নাম রয়েছে? হোয়াটসঅ্যাপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘ডিপি’ (ডিসপ্লে পিকচার) বদলে দেন হৈমন্তী। তাতেই রহস্য আরও বেড়েছে।
যদিও হৈমন্তী কোথায় রয়েছেন, তা এখনও জানা যায়নি। হাওড়ায় পৈতৃক বাড়ির আশপাশেই কোথাও রয়েছেন? না কি টালিগঞ্জে কোথাও?
নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত পার্থের বাড়িতে যখন অভিযান চালিয়েছিল ইডি, ওই একই সময় তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতেও চলেছিল তল্লাশি। উদ্ধার হয়েছিল কোটি কোটি টাকা। ক্রমে সেই দুর্নীতিতে নাম জড়িয়েছে একের পর এক নেতা, মন্ত্রী থেকে বিধায়কের। এ বার কুন্তলকে জেরার সূত্রে উঠে এল হৈমন্তীর নাম। যদিও তিনি এখন কোথায়, সেই প্রশ্নই ঘুরছে তদন্তকারীদের মধ্যে। ছবি: সমাজমাধ্যম থেকে