ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছিল, তা অসাংবিধানিক নয় বলে সোমবার জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই রায়কে ঐতিহাসিক বলে মন্তব্য করেছেন।
৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর কিছু বিশেষ সুবিধা ভোগ করত। ২০১৯ সালে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের সেই বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সাবেক জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখে ভাগ করা হয়।
কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে অনেকগুলি মামলা হয়েছিল। সেগুলিকে একত্রিত করে শীর্ষ আদালতে শুনানি শুরু হয় গত ২ জুলাই। ৫ সেপ্টেম্বর এই বিষয়ে রায়দান স্থগিত রাখে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ।
প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এ প্রসঙ্গে রায় শুনিয়েছে সোমবার। প্রধান বিচারপতি ছাড়াও ওই বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি সঞ্জয় কিসান কল, বিচারপতি সঞ্জীব খান্না, বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি সূর্য কান্ত।
সোমবার শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল অসাংবিধানিক নয়। সরকারের সিদ্ধান্তে ভুল ছিল না। একই সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদাও ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব জম্মু ও কাশ্মীরকে আবার রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। সেখানে বিধানসভা নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। তার সময়ও নির্দিষ্ট করেছে শীর্ষ আদালত।
বিচারপতিরা জানিয়েছেন, আগামী ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচন করতে হবে। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা পেলেও লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবেই থাকছে।
পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ হলেও তিন ভাগে ৩৭০ অনুচ্ছেদের মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। প্রথমে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় রায় পড়ে শোনান।
বিচারপতি গাভাই এবং বিচারপতি সূর্য কান্তের রায় প্রধান বিচারপতির রায়ের সঙ্গেই একত্রে পড়ে শোনানো হয়। আলাদা করে রায় পড়েন বিচারপতি কল এবং বিচারপতি খান্না।
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় প্রথমেই জানান, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক বলে মনে করে না সুপ্রিম কোর্ট। তাঁরা সর্বসম্মত একটি রায় ঘোষণা করবেন।
তিনি আরও বলেন, ‘‘অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর মাধ্যমে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা আসলে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। নিতান্তই সাময়িক ভাবে তা প্রয়োগ করা হয়েছিল।
আদালত জানায়, ভারতের সঙ্গে যে দিন থেকে জম্মু ও কাশ্মীর যুক্ত হয়েছে, সে দিন থেকেই ওই রাজ্যের আলাদা করে কোনও অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব নেই। তা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
২০১৮ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তার পর সেখানে জারি করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসন। ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট জম্মু-কাশ্মীর সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি।
এর মাধ্যমে সংবিধানে ৩৬৭(৪) নম্বর অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়। ফলে সংবিধানের ৩৭০(৩) নম্বর ধারায় ‘রাজ্যের সংবিধান সভা’-র বদলে ‘রাজ্যের বিধানসভা’ শব্দটি যোগ হয়েছিল। সে দিনই সংসদে বিশেষ মর্যাদা লোপ এবং জম্মু-কাশ্মীর ভাগের বিল পাশ হয়। পরের দিন রাষ্ট্রপতি জানান, ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ আর কার্যকর হচ্ছে না।
সোমবার আদালত জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতির এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বৈধ। জম্মু ও কাশ্মীরের গণপরিষদ বাতিল হয়ে যাওয়ার পরেও রাষ্ট্রপতি এটি করতে পারেন।
কেন প্রয়োগ করা হয়েছিল অনুচ্ছেদ ৩৭০? সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কল জানান, অনুচ্ছেদ ৩৭০ জম্মু ও কাশ্মীরে আনা হয়েছিল ওই রাজ্যটিকে ভারতের বাকি রাজ্যগুলির সঙ্গে সমান করে তোলার জন্য।
বিচারপতি কল তাঁর পৃথক রায়ে বলেন, ‘‘শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা সেনার কাজ। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তাদের কাজ নয়। কাশ্মীরের অন্দরে সেনা প্রবেশ করায় তার কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।’’
বিচারপতি খান্না তাঁর রায়ে বলেন, ‘‘কাশ্মীরে অনুচ্ছেদ ৩৭০ অপ্রতিসম ফেডেরালিজমের উদাহরণ ছিল। তা কখনও জম্মু ও কাশ্মীরের সার্বভৌমত্বের নির্দেশক নয়। তাই ওই অনুচ্ছেদ বাতিল কাশ্মীরের ফেডেরালিজম অক্ষুণ্ণই রেখেছে।’’
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে খুশি নয় কাশ্মীরের বিজেপি-বিরোধী দলগুলি। এনসি নেতা ওমর আবদুল্লা সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পর জানান, তিনি হতাশ। তবে আশাহত হননি। দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রস্তুতি তাঁরা নেবেন বলেও জানান। ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ আজাদ পার্টি-র চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ এই রায়কে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেছেন।