প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একের পর এক আক্রমণের পর আবারও কচ্চতীবু দ্বীপ নিয়ে বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে। এই দ্বীপের অধিকার ভারতের না শ্রীলঙ্কার, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধীদের আক্রমণ করতে কচ্চতীবু দ্বীপকে হাতিয়ার করেছেন মোদী। প্রথমে কংগ্রেস, তার পর ডিএমকেকেও নিশানা করেছেন তিনি।
সম্প্রতি কচ্চতীবু দ্বীপ সংক্রান্ত একটি তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। তথ্যের অধিকার আইনের (আরটিআই) সেই রিপোর্টকে সামনে রেখে কংগ্রেস এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নিশানা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে মোদী লেখেন, ‘‘কচ্চতীবু দ্বীপ নিয়ে আরটিআই রিপোর্ট খুবই চমকপ্রদ। এই রিপোর্ট আমাদের চোখ খুলে দিচ্ছে। এখান থেকে পরিষ্কার, কংগ্রেস কেমন নিষ্ঠুর ভাবে ওই দ্বীপ শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দিয়েছিল।’’
তিনি আরও লেখেন, ‘‘দেশের প্রত্যেক নাগরিক এতে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, কংগ্রেসকে বিশ্বাস করা যায় না।’’ কচ্চতীবু দ্বীপ প্রসঙ্গে কংগ্রেসের পাশাপাশি ডিএমকে-কেও আক্রমণ করেছেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘কংগ্রেস এবং ডিএমকে শুধু নিজেদের পরিবারের কথা ভাবে। অন্য কিছু নিয়ে পরোয়ো করে না। কচ্চতীবু দ্বীপ নিয়ে তাদের উদাসীনতা ভারতের দরিদ্র মৎস্যজীবীদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে।’’
কচ্চতীবু দ্বীপ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। কচ্চতীবু দ্বীপের অধিকার বর্তমানে শ্রীলঙ্কার হাতে রয়েছে। এই দ্বীপটি ভারত এবং শ্রীলঙ্কার মাঝখানে অবস্থিত। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ১.৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে এই দ্বীপ।
কচ্চতীবু দ্বীপটি একটি ছোট এবং নির্জন দ্বীপ। এখানে কোনও স্থায়ী ঘরবাড়ি নেই। তবে একটি গির্জা রয়েছে। ভারত এবং শ্রীলঙ্কা, দুই দেশের মানুষই প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে তীর্থ করতে এই গির্জায় যান।
ভারত এবং শ্রীলঙ্কার অনেক মৎস্যজীবীই কচ্চতীবু দ্বীপের আশপাশের সমুদ্র এলাকার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই দ্বীপে মাছ ধরা এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দু’দেশের মৎস্যজীবীদের মধ্যে মতবিরোধ অনেক দিনের।
ব্রিটিশ শাসনকালে কচ্চতীবু দ্বীপ ছিল তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অধীনে। ১৯২০ সাল থেকেই এই দ্বীপ নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। এই দ্বীপ রামনাদ রাজ্যের অংশ ছিল বলে ভারতের তরফে দাবি করা হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই দ্বীপ তামিলনাড়ুর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ভারতের কাছে এই দ্বীপের দাবি জানায়। বন্ধুত্ব বজায় রাখতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মৌখিক ভাবে শ্রীলঙ্কাকে কচ্চতীবু দ্বীপে সে দেশের মৎস্যজীবীদের আসার এবং মাছ ধরার অধিকার দেন।
তবে তাতেও বিরোধ মেটেনি দু’দেশের মৎস্যজীবীদের মধ্যে। ১৯৭৪ সালে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক কচ্চতীবু দ্বীপের অধিকার চেয়ে আবদার করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার কাছে।
বন্দরনায়েকের কথা মেনে নেন জওহরলাল নেহরুর কন্যা। তিনি চুক্তি সই করে কচ্চতীবু দ্বীপ শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দেন। তবে শর্ত ছিল, ভারতের মৎস্যজীবীরাও যেতে পারবেন ওই দ্বীপে। মাছ ধরা-সহ দ্বীপের সমস্ত অধিকারও থাকবে ভারতীয়দের।
কিন্তু বন্দরনায়েক সরকার শ্রীলঙ্কার মসনদ থেকে সরে যেতেই আবার নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়। সে দেশের নতুন সরকার কচ্চতীবু দ্বীপের উপর ভারতের অধিকার খর্ব করে। তার পরই ভারতীয়েরা, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর মৎস্যজীবীরা সমস্যায় পড়েন।
ইন্দিরার আমলে করা চুক্তি নিয়ে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে ওঠে। কংগ্রেস-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দাবি ছিল, কচ্চতীবু দ্বীপে ভারতীয় মৎস্যজীবীদের দীর্ঘ দিনের মাছ ধরার অধিকার লঙ্ঘন করেছে ওই চুক্তি। তাই দ্বীপটি পুনরুদ্ধার এবং তার উপর আবার ভারতের শাসন বহাল করার দাবি ওঠে।
গত কয়েক দশক শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের মধ্যে বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল কচ্চতীবু দ্বীপের অধিকার। প্রায়ই দু’দেশের মৎস্যজীবীদের মধ্যে এই দ্বীপের অধিকার নিয়ে হিংসার ঘটনা ঘটেছে। রক্ত ঝরেছে। অনেক ভারতীয় মৎস্যজীবী বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন।
তামিলনাড়ুর অনেকের দাবি ছিল, ১৯৭৪ সালের চুক্তি প্রত্যাহার করে কচ্চতীবু দ্বীপ আবার ভারতকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু দু’দেশের কোনও সরকারই এই দাবি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি।
কচ্চতীবু দ্বীপের সমস্যা নিয়ে একটি স্থায়ী সমাধানের দাবিও জানানো হয়েছে। কারণ, এই সব সমস্যার কারণে দু’দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব নষ্ট হচ্ছে। রামেশ্বরম-সহ তামিলনাড়ুর বেশ কিছু জেলা থেকে মৎস্যজীবীরা অনেক সময় কচ্চতীবু দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে যান। শ্রীলঙ্কার জলসীমার মধ্যে ঢুকে পড়ায় তাঁদের আটকও করা হয়।
সম্প্রতি তামিলনাড়ুর বিজেপি সভাপতি কে অন্নামালাই তথ্য জানার অধিকার আইনে কচ্চতীবু দ্বীপ সম্পর্কে রিপোর্ট জোগাড় করেন। তার ভিত্তিতেই রবিবার মোদীর এই পোস্ট। নির্বাচনের আগে আবারও এক বার সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এল এই কচ্চতীবু দ্বীপ।