বুধবার ভোর থেকে আতঙ্কে ডুবে রয়েছে সিকিম। মেঘভাঙা বৃষ্টিতে লোনাক হ্রদ ফেটে পড়েছে। খরস্রোতা নদীতে হড়পা বান। তিস্তার জলস্তর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হাহাকার পড়ে গিয়েছে চারিদিকে। তিস্তার ধ্বংসলীসায় বলি হয়েছেন অন্তত ১৪ জন। এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ ১২০ জন।
কিন্তু তিস্তার জলস্তরের মতো এই সংখ্যাও বাঁধ ভেঙেছে। ঘড়ির কাঁটা যত সামনের দিকে এগোচ্ছে, ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে নিখোঁজের সংখ্যা। মৃতের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর কেমন রয়েছে সেই পাহাড়ি রাজ্য?
২৪ ঘণ্টা পরেও শান্ত হয়নি সিকিম। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ধস নামছে ক্রমাগত। বৃহস্পতিবার সকালেও বড়সড় ধস নেমেছে রাজ্যের ২৯ মাইল এলাকায়। ধসের ফলে ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক (সাবেক ৩১এ জাতীয় সড়ক) এখন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
তিস্তা ব্রিজ থেকে সিকিম যাওয়ার পথে বেশ কিছু জায়গায় বড় আকারের ধসের কারণে জাতীয় সড়ক নিচের দিকে বসে গিয়েছে।
বুধবার দুপুর নাগাদ ২৮ মাইল এলাকায় ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের রাস্তায় ধস নামে। জাতীয় সড়কের বিভিন্ন জায়গা ধীরে ধীরে তিস্তার নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে বলে প্রশাসন সূত্রে খবর।
তিস্তার ধ্বংসলীলার প্রভাব পড়েছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতেও। কালিম্পং জেলার তিস্তা বাজার এবং তিস্তা সংলগ্ন এলাকা থেকে জল নামতে শুরু করেছে। এর ফলে সেখানকার মাটিও সরছে ধীরে ধীরে।
পলি সরতেই তার তলা থেকে উঁকি দিচ্ছে বাড়ির ধ্বংসাবশেষ থেকে গাড়ি। তিস্তা যা নদীগর্ভে গিলে রেখেছিল পলি সরতে তার ভয়াবহতা প্রকাশ্যে এসেছে।
মঙ্গলবার রাতে প্রাণরক্ষার খাতিরে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিস্তাবাজার এবং তিস্তা সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের সকলকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁদের সর্বস্ব যে পড়ে রয়েছে তিস্তার পারে!
মঙ্গলবারের মধ্যরাত থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত তিস্তায় জলস্তর ব্যাপক পরিমাণে ছিল। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বৃষ্টি খানিকটা কমে যাওয়ার ফলে তিস্তার জলস্তরও অল্প অল্প করে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে।
তিস্তার জল কমে আসতেই জমা পলি থেকে বেরিয়ে আসছে এক কঙ্কালসার চেহারা। পাহাড়ের উঁচুর দিকে বসতির প্রায় সবই যেন ধুয়ে ফেলেছে তিস্তা। যদিও তিস্তার পার সংলগ্ন এলাকার কিছু বাড়িঘর এখনও অবশিষ্ট রয়েছে।
বর্তমানে কালিম্পং থেকে তিস্তা বাজার হয়ে দার্জিলিং যাওয়ার একমাত্র রাস্তার বেহাল পরিস্থিতি। তিস্তা বাজারে মেন রোডের উপরে বুধবার রাত থেকে তিস্তার জল উঠতে শুরু করে। এমনকি সেই জল বাড়তে বাড়তে বাড়ির ভিতরেও ঢুকে যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পুরোপুরি অচল হয়ে রয়েছে এই এলাকা।
বৃহস্পতিবার সকালে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। রাজ্যপাল নামার পরে বিমানবন্দরে নামেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। যদিও বিমানবন্দরে নামার পর রাজ্যপাল কোনও বক্তব্য পেশ করেননি।
বিমানবন্দর থেকে সোজা স্টেট গেস্ট হাউসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন রাজ্যপাল। সেখান থেকে সমতলের মূলত জলপাইগুড়ি লাগোয়া এলাকাগুলি পরিদর্শনে যাওয়ার কথা তাঁর। দুপুরের বিমানেই কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে তাঁর৷
ধ্বংসলীলা দেখার পর রাজ্যপালের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘দুর্ঘটনা নিতান্ত কাকতালীয় নয়।’’ উন্নয়নের নামে নির্বিচারে প্রকৃতি নিধন নিয়েও নিজের মত ব্যক্ত করেছেন রাজভবনের বাসিন্দা।
অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে যান রাজ্যের সেচমন্ত্রী পার্থ। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এসেছি। দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করব। তার পর সিদ্ধান্ত নেব কোথায় যাব। কোথাকার কী পরিস্থিতি, আমরা কত দূর কী করতে পারব সে সব নিয়েই আলোচনা হবে।’’
সেনা সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী, বুধবার ভোরে হঠাৎ ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় জলের স্রোত নামে তিস্তায়। এক ধাক্কায় বেড়ে যায় জলস্রোত। সেই জলই ভাসিয়ে নিয়ে যায় রাস্তা, ঘর, বাড়ি, গাড়ি— সব কিছু। বন্যার তোড়ে ভেসে যায় লাচেন উপত্যকা।
উত্তর সিকিমের সিংতামের কাছে বরদাংয়ের সেনাছাউনিতে কাদাজলের নীচে ডুবে গিয়েছে সেনাবাহিনীর ৪১টি গাড়ি। ডুবে গিয়েছে ছাউনিও।
বুধবার সকালে ২৩ জন জওয়ানের নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত এক জন জওয়ানকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ওই জওয়ানের শারীরিক অবস্থা আপাতত স্থিতিশীল বলে জানা গিয়েছে।