প্রবল বৃষ্টি এবং ভূমিধসে বিপর্যস্ত ‘ঈশ্বরের নিজের দেশ’। কেরলের ওয়েনাড়ে জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে বহু পরিবার। অনেকে স্বজন হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। অনেকে আবার নিখোঁজ প্রিয়জনদের খোঁজে পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন।
ওয়েনাড়ে ভূমিধসে মৃতের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ২৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। তবে ভারী বর্ষণে উদ্ধারকাজ থমকে যাচ্ছে বার বার।
তবে এই পরিস্থিতিতে আরও এক বিষয় ভাবাচ্ছে কেরলের পুলিশকে। তা হল ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’। বার বার পর্যটকদের বৃষ্টি বিপর্যস্ত এলাকাগুলিতে ঘুরে বেড়াতে বারণ করছে কেরলের পুলিশ।
কেরল, যা ভারতের অন্যতম সেরা পর্যটন গন্তব্য হিসাবে বিবেচিত হয়, সেখান থেকেই মানুষকে আপাতত দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে প্রশাসন। ওয়েনাড়-সহ কেরলের বিভিন্ন বিধ্বস্ত এলাকায় মানুষকে ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যেই এই পদক্ষেপ।
এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে কেরল পুলিশের বার্তা, ‘‘শুধুমাত্র দেখার জন্য বিপর্যস্ত এলাকাগুলিতে যাবেন না। এতে উদ্ধারকাজে বাধা পড়বে। সাহায্যের জন্য অনুগ্রহ করে ১১২ নম্বরে ফোন করুন।’’
কিন্তু কী এই ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’, যা এত ভাবাচ্ছে কেরলের প্রশাসনকে?
ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা বা বহু মৃত্যুর সাক্ষী থাকা জায়গাগুলিতে পরিদর্শনে যাওয়ার ইচ্ছাকেই ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’ বলে। বিশ্বব্যাপী বহু বছর ধরেই ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’-এর চল রয়েছে। বিগত কয়েক বছরে এর চল অনেকটাই বেড়েছে।
যুদ্ধ, গণহত্যা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ঘটনা, হাহাকার, অপরাধ, দুর্ভোগ এবং দুঃখ জড়িয়ে রয়েছে যে ঐতিহাসিক জায়গাগুলিতে, মূলত সেগুলিই ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’ পর্যটকদের ঘুরতে যাওয়ার জায়গা।
‘থানা ট্যুরিজ়ম’ এবং ‘গ্রিফ ট্যুরিজ়ম’ নামেও পরিচিত ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার বা পলায়নবাদের প্রবণতা যাঁদের, তাঁরাই ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’-এ যেতে বেশি পছন্দ করেন।
এমনকি বেশ কয়েকটি সংস্থা রয়েছে, যারা ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’-এর আয়োজন করে থাকে।
বিশ্বব্যাপী এমন প্রচুর জায়গা রয়েছে, যা ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’ পছন্দ করা মানুষের গন্তব্য। তার মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ আফ্রিকার রবেন দ্বীপ, যেখানে নেলসন ম্যান্ডেলা ১৮ বছরের জন্য বন্দি ছিলেন।
এ ছাড়াও আউশউইৎস (নাৎসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প) থেকে চেরনোবিল পরমাণু দুর্ঘটনার স্থল থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যার জায়গা— এই সবই ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’ পর্যটকদের পছন্দের জায়গা।
‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’ নতুন নয়, বহু যুগ ধরে এর চল রয়েছে। আমেরিকার পর্যটনের অধ্যাপক জে জন লেনন ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’কে বলেছেন, ‘‘এমন প্রমাণও রয়েছে যে, যখন ওয়াটারলু যুদ্ধ হচ্ছিল, তখন অনেক মানুষ সেই যুদ্ধ দেখতে পৌঁছে গিয়েছিলেন।’’ এমনকি, ফ্রান্সে জনসমক্ষে ফাঁসি দেখার জন্যও প্রচুর মানুষ ভিড় জমাতেন বলেও তিনি মনে করিয়েছেন।
তবে যা বিশেষজ্ঞদের ভাবাচ্ছে, তা হল ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’ নিয়ে উত্তরোত্তর মানুষের কৌতূহল বৃদ্ধি। মানুষের চোখের জল এবং হাহাকারের সাক্ষী রয়েছে এমন জায়গাগুলিতে পর্যটকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে গত কয়েক দশকে।
আমেরিকার একটি ওয়েবসাইটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তারা ৯০০ জনের উপর সমীক্ষা চালিয়ে জানতে পেরেছে যে, তাঁদের মধ্যে ৮২ শতাংশ মানুষ অন্তত একটা ‘অন্ধকার’ পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে এসেছেন। এঁদের অনেকে আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেন সফরে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন।
ভারতেও ‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’ করার অনেক জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেল, উত্তরাখণ্ডের রূপকুণ্ড হ্রদ বা জয়সলমেরের কুলধারার মতো জায়গা জনপ্রিয়।
সেলুলার জেল ব্রিটিশ ভারতে আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একটি কারাগার ছিল। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর উপর হওয়া অত্যাচারের সাক্ষী এই জেল।
উত্তরাখণ্ডের রূপকুণ্ড হ্রদে বহু মানুষের কঙ্কালের অবশেষ রয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে সেই কঙ্কালগুলি এল, তা এখনও রহস্য।
অন্য দিকে, জয়সলমেরের কুলধারা একটি ‘ভৌতিক’ গ্রাম। কিংবদন্তি অনুযায়ী, রাতারাতি এই গ্রামের সব মানুষ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।
‘ডার্ক ট্যুরিজ়ম’-এর অন্ধকার দিকও রয়েছে। মানুষের মননে এর কুপ্রভাব পড়তে পারে বলেও সাবধান করেছেন বিশেষজ্ঞেরা।
পাশাপাশি, সদ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে এমন জায়গাতে উদ্ধারকাজ চলার মধ্যেই সেখানে ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতা কিছু মানুষের মধ্যে এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে কেরল প্রশাসন। আর সেই কারণেই মানুষকে ওয়েনাড়ে ঘুরতে যেতে বারণ করছে পুলিশ।