দেশ জুড়ে ‘অগ্নিপথ’ নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ছে। যার রেশ এসে পড়েছে বাংলাতেও। শুক্রবার সকালেই শিয়ালদহ-বনগাঁ শাখায় ঠাকুরনগর স্টেশনে ট্রেন অবরোধ করা হয়। যার জেরে সমস্যায় পড়েন নিত্যযাত্রীরা।
বিহার, রাজস্থান, হরিয়ানা—এমনকি দক্ষিণেও প্রতিবাদের আগুন পৌঁছেছে। প্রতিবাদীরা জ্বালিয়ে দিচ্ছেন ট্রেন, বাস।
প্রতিবাদীদের বক্তব্য, সেনাবাহিনীর চাকরিতে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ কেন হবে? কেনই বা অগ্নিপথ প্রকল্প থেকে মাত্র ২৫ শতাংশকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে?
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, অগ্নিপথ প্রকল্প প্রথমে নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক ভাবে পরিচালনা করা উচিত। একই সঙ্গে এই প্রকল্প ধীরে ধীরে এবং সমস্ত উদ্বেগের দিকগুলি নিয়ে পর্যালোচনা করে বাস্তবায়িত করা উচিত বলেও তাঁদের মত।
এক ইংরেজি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমন মত ব্যক্ত করেছেন প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস্ (ডিজিএমও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিনোদ ভাটিয়া। তাঁর কথার অনুরণন শোনা গিয়েছে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)-এর প্রাক্তন এডিজি সঞ্জীব সুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার প্রফুল্ল বক্সীর কণ্ঠেও।
এই প্রকল্প নিয়ে দেশ জুড়ে তৈরি হওয়া অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির কারণ উল্লেখ করে ভাটিয়া বলেন, “একটি পদের জন্য শতাধিক প্রার্থী আবেদন করেন। কিন্তু এই প্রকল্পের ফলে যাঁরা সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদান করতে চান, তাঁরা আরও ভাল চাকরির জন্য অন্য সংস্থায় যাবেন। এই প্রার্থীরা আধাসামরিক বাহিনীতে বা পুলিশে চাকরির চেষ্টা করবেন। এর ফলে আমরা সেনাবাহিনীতে সেরা সৈন্যদের পাবো না।’’
একই সঙ্গে তিনি ভাটিয়া মনে করছেন, ‘‘এ ছাড়াও সেনাদলে যোগ দিতে ইচ্ছুকেরা চার বছরের জন্য কেন যোগ দেবেন? এই স্বল্প মেয়াদের জন্য কেন তাঁরা ঝুঁকি নেবেন?’’
এই প্রকল্পের ফলে সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ভাটিয়া আরও জানান, সেনাবাহিনীতে বেশি প্রার্থী নিয়োগ করার পাশাপাশি এ-ও খেয়াল রাখতে হবে, যাতে সেনাবাহিনীর মান বজায় থাকে।
এই প্রকল্প সেনাদলের ক্ষমতা এবং কার্যকারিতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে বলেও মনে করছেন তিনি। একই সঙ্গে প্রকল্প নিয়ে ভাল ভাবে চিন্তা করা হয়নি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)-এর প্রাক্তন এডিজি সঞ্জীব সুদ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি এই প্রকল্পে বেশ কিছু প্রাথমিক ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন।
সঞ্জীব বলেন, ‘‘অগ্নিপথ প্রকল্পের চার বছরের চাকরিতে এক জন সেনা সদস্যকে ছ’মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং তিনি মাত্র তিন বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে থাকবেন। সেনাদের উপযুক্ত ভাবে গড়ে তোলার জন্য তিন বছর যথেষ্ট সময় নয় এবং সেনারাও এত কম সময়ে নিজেদের দেশের স্বার্থে নিজেদের সঁপে দিতে পারবে না।’’
সঞ্জীব আরও জানান, চার বছরের চাকরিতে অগ্নিপথ প্রকল্পের আওতায় যোগ দেওয়া সেনারা কার্গিলের যুদ্ধে যোগ দেওয়া সেনাদের মতো লড়াই করবে, এই আশা কখনই করা উচিত না।
অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার প্রফুল্ল বক্সীর মতে এই প্রকল্পের আওতায় সেনা সদস্যদের কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ বছর দেশের সেবা করার সুযোগ দেওয়া উচিত।
১৪ জুন মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ অগ্নিপথ প্রকল্পের ঘোষণা করেন। ঘোষণা করা হয়, এই প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ১৭-২১ বছরের তরুণ-তরুণীরা চার বছরের জন্য মাসিক ৩০-৪৫ হাজার টাকার চুক্তির ভিত্তিতে সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখায় (স্থল, নৌ এবং বায়ুসেনা) যোগ দিতে পারবেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান, ওই সদস্যদের বলা হবে ‘অগ্নিবীর’। সেনায় শূন্যপদ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চতুর্থ বছরের শেষে সেই ব্যাচের সর্বাধিক ২৫ শতাংশ অগ্নিবীরকে সেনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বাকিদের ১১-১২ লক্ষ টাকা হাতে দিয়ে পাঠানো হবে অবসরে। থাকবে না কোনও পেনশন।
রাজ্যে রাজ্যে আন্দোলন শুরুর পরে বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক যোগদানের বয়সসীমা এককালীন (শুধু প্রথম বার নিয়োগের ক্ষেত্রে) বাড়িয়ে ২৩ করেছে।
আর কেন্দ্রের এই ঘোষণার পর পরই দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তৈরি হয়েছে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। বিক্ষোভ দেখাতে পথে নেমেছেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক যুবকেরা।
ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের এই প্রকল্পের প্রশংসা করে বার্তা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
শুক্রবার রাজনাথ টুইট করে বলেছেন এই প্রকল্পে কাজ করার ‘সুবর্ণ সুযোগ’ যেন দেশের যুবসমাজ না হারান।