গত শনিবার রাতে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয় অজিত পওয়ারপন্থী এনসিপি গোষ্ঠীর নেতা তথা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকিকে। এই খুনের ঘটনায় দুই আততায়ী এবং এক চক্রীকে গ্রেফতার করেছে মুম্বই পুলিশ। রবিবারই তাঁদের মুম্বইয়ের এসপ্ল্যানেড আদালতে পেশ করা হয়।
এই নিয়ে মহারাষ্ট্র জুড়ে হইচই পড়েছে। তাবড় নেতা-মন্ত্রী-ব্যবসায়ী-অভিনেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে ওয়াই ক্যাটাগরির নিরাপত্তা পেয়েও যদি সিদ্দিকিকে এ ভাবে খুন হতে হয়, তা হলে এমন আঁটসাঁট নিরাপত্তার মানেটা কী?
এই নিয়ে বিতর্ক এবং প্রশ্নপর্ব অব্যাহত। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক ভারতের গণ্যমাণ্য ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন। কারাই বা পাহারা দেন তাঁদের?
‘এক্স’, ‘ওয়াই’ এবং ‘জ়েড’। ইংরেজি বর্ণমালার শেষ তিন অক্ষরের ব্যঞ্জনা পাল্টে যায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার শব্দকোষে। ভারতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরে হাই প্রোফাইল ব্যক্তিত্বদের যে নিরাপত্তা দেওয়া হয়, তার স্তরবিন্যাসে ব্যবহার করা হয় এই অক্ষরগুলি।
নিশ্ছিদ্র এই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে মূলত ৬ ভাগে ভাগ করা যায়। ‘এক্স’, ‘ওয়াই’, ‘ওয়াই প্লাস’, ‘জ়েড’, ‘জ়েড প্লাস’ এবং ‘এসপিজি’ বা ‘স্পেশ্যাল প্রোটেকশন গ্রুপ’। যাঁর জীবন যতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তাঁর জন্য তেমন শক্তিশালী নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ, হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, প্রথম সারির রাজনীতিক এবং শীর্ষ আমলারা সাধারণত এই চার স্তরের নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন।
পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে এই নিরাপত্তার বলয় পেতে পারেন শিল্পপতি, তারকা, খেলোয়াড়-সহ অন্যান্য বিশিষ্ট নাগরিক। প্রয়োজনে সাধারণ নাগরিককেও এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেওয়া হতে পারে।
ব্রিটিশ ঘরানা অনুসরণ করে ভারতের রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে ‘প্রেসিডেন্টস বডিগার্ড’ বা ‘পিবিজি’। ভারতীয় সেনার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলির মধ্যে অন্যতম এই ‘পিবিজি’।
বাকি ক্ষেত্রে ‘এক্স’, ‘ওয়াই’, ‘জ়েড’ এবং ‘এসপিজি’ সংক্রান্ত নিরাপত্তার যে বিন্যাস, তার দেখাশোনার দায়িত্বে মূলত থাকে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স বা সিআরপিএফ এবং সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিয়োরিটি ফোর্স বা সিআইএসএফ।
ভারতে ‘স্পেশ্যাল প্রোটেকশন গ্রুপ’ বা এসপিজির নিরাপত্তা পান শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী। তার জন্য বার্ষিক ব্যয়ের পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা।
আগে সনিয়া গাঁধী এবং রাহুল ও প্রিয়ঙ্কার জন্যেও বরাদ্দ ছিল এসপিজি নিরাপত্তা। ২০১৯ সালের ৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে এসপিজির পরিবর্তে তাঁদের জন্য বরাদ্দ করা হয় ‘জ়েড প্লাস’ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
এসপিজির জন্য নিরাপত্তারক্ষীদের নেওয়া হয় সিআরপিএফ এবং আরপিএফ থেকে। তবে আধিকারিকেরা আসেন আইপিএস এবং সিআরপিএফ থেকে।
অত্যাধুনিক অস্ত্রের পাশাপাশি এই নিরাপত্তা বলয়ের বৈশিষ্ট্য বিএমডব্লিউ, রেঞ্জ রোভার, মার্সিডিজ়, টাটা সাফারির গাড়ি। আকাশপথে যাতায়াতের সময় ব্যবহার করা হয় এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং বিমান অথবা এম আই-১৭ হেলিকপ্টার।
এসপিজিতে মোট ৩০০০ নিরাপত্তা আধিকারিক থাকেন। বাহিনীতে থাকে বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর এসপিজি গঠন করা হয়।
জ়েড প্লাস ব্যবস্থায় জ়েড-এর সব সুযোগ-সুবিধা তো পাওয়াই যায়। সেই সঙ্গে যোগ হয় বুলেটপ্রুফ গাড়ি এবং বাড়তি কিছু নিরাপত্তা। ১০ জনের বেশি এনএসজি কম্যান্ডো-সহ ৫৫ জন নিযুক্ত থাকেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিরাপত্তার দায়িত্বে।
ভারতে যাঁরা জ়েড প্লাস নিরাপত্তা পান, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং রাজনাথ সিংহ, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার, শিল্পপতি মুকেশ অম্বানী-সহ আরও অনেকে।
জ়েড নিরাপত্তা ব্যবস্থায় চার থেকে পাঁচ জন এনএসজি কম্যান্ডো-সহ ২২ জন নিরাপত্তারক্ষী দিনভর মোতায়েন করা থাকে বাড়ির চারপাশে। বাড়ির বাইরে যে কোনও সফরে সর্ব ক্ষণের জন্য থাকেন নিরাপত্তারক্ষী এবং সশস্ত্র প্রহরী।
ওয়াই প্লাস নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এক জন সিআরপিএফ কম্যান্ডার, চার জন কনস্টেবল-সহ মোট পাঁচ জন নিরাপত্তারক্ষী সব সময় বাড়ির চারপাশে মোতায়েন থাকেন। পাশাপাশি, ছ’জন পার্সোনাল সিকিয়োরিটি অফিসার বা পিএসও নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে থাকেন ঘুরেফিরে বিভিন্ন শিফ্টে। বলি অভিনেতা শাহরুখ খান এবং সলমন খান ওয়াই প্লাস নিরাপত্তা ব্যবস্থা পান।
ওয়াই শ্রেণিতে দু’জন পিএসওর পাশাপাশি দায়িত্বে থাকেন আরও এক জন সশস্ত্র প্রহরী। যিনি নিরাপত্তা পাচ্ছেন, তাঁর বাড়িতে এই তিন জন সব সময় মোতায়েন থাকেন। পাশাপাশি রাতের জন্য বরাদ্দ করা হয় বাড়তি নিরাপত্তা। এক অথবা দু’জন কম্যান্ডো-সহ ১১ জন থাকেন নিরাপত্তারক্ষার দায়িত্বে। নিহত এনসিপি নেতা বাবা সিদ্দিকি এই শ্রেণির নিরাপত্তা পেতেন।
এক্স শ্রেণির নিরাপত্তায় সারাক্ষণের জন্য থাকেন দু’জন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আধিকারিক বা পিএসও। অর্থাৎ বিভিন্ন শিফ্টে দিনভর দায়িত্বপালন করেন মোট ছ’জন পিএসও।