৭৭ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন বর্ষীয়ান সঙ্গীতশিল্পী বাণী জয়রাম। চেন্নাইয়ের বাড়ি থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কী ভাবে এই মৃত্যু তা স্পষ্ট নয় এখনও।
পুলিশ জানিয়েছে, শিল্পীর কপালে আঘাতের চিহ্ন ছিল। ময়নাতদন্তের জন্য দেহ পাঠানো হয়েছে হাসপাতালে। বাণীর মৃত্যুর পর শোকের ছায়া নেমে এসেছে সঙ্গীত জগতে।
১৯৪৫ সালে ভেলোরে জন্ম বাণীর। সারা জীবনের কেরিয়ারে হিন্দি ছাড়াও তামিল, তেলুগু, মালয়ালম, কন্নড় ভাষায় ১০ হাজারের বেশি গান রেকর্ড করেছেন তিনি। তাঁর কণ্ঠে মুগ্ধ হয়েছিলেন আট থেকে আশি, সকলেই।
১৯৭১ সালে ‘গুড্ডি’ ছবিতে জয়া ভাদুড়ির কণ্ঠে ‘বোল রে পাপিহারা’ গানটি রেকর্ড করেছিলেন বাণী। এই গান তাঁকে হিন্দি সঙ্গীতের দুনিয়ায় বিশেষ খ্যাতি এনে দেয়। আবার এই গানের পর থেকেই নাকি বলিউড থেকে ক্রমশ হারিয়ে যান বাণী।
সত্তর-আশির দশকে ভারতীয় সিনেমায় নেপথ্যে সঙ্গীতের জগতে ছিল লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলেদের একচ্ছত্র রাজত্ব। একের পর এক সুপারহিট গান গেয়ে চলেছিলেন তাঁরা। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন নিমেষে।
অনেকের মতে, লতার ছটায় ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণী কন্যা বাণী। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তাই বলিউডে তিনি যোগ্য মর্যাদা পাননি। প্রকাশ্যে না হলেও লতার বিরুদ্ধে বাণী ইঙ্গিতে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন বলে শোনা যায়।
২০০০ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বাণীকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘বোল রে পাপিহারা’ গানটির বিপুল সাফল্যের পরেও কেন হিন্দি গানে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলেন না তিনি?
উত্তরে বাণী জানিয়েছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তিনি বেশি জলঘোলা করতে চান না। খুব বেশি গানের প্রস্তাব আর তিনি পাননি। কিছু দিন বলিউডে ছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই উপলব্ধি করেন প্রথম সারির বলিউড ছবিতে গাইতে ডাকা হচ্ছে না তাঁকে। তিনি পাচ্ছেন অপেক্ষাকৃত কম বাজেটের ছবির প্রস্তাব।
হিন্দি সিনেমায় বাণীর কেরিয়ার কি পেশাদার কোনও হিংসাত্মক মনোভাবের কারণে ফিকে হয়ে গিয়েছিল? উত্তরে শিল্পী বলেন, ‘‘আমি কারও নাম করে তিক্ততা বাড়াতে চাই না। তবে শমশাদ বেগম কিংবা সুমন কল্যাণপুরের মতো শিল্পী কেন গুরুত্ব পাচ্ছেন না? কিছু তো কারণ আছেই। অনেকেই ইন্ডাস্ট্রি থেকে হারিয়ে গিয়েছেন। আমি তাঁদের মতোই হেরে গিয়েছি।’’
লতা এবং আশা প্রসঙ্গে বাণী আরও বলেন, ‘‘ওঁরা দু’জনেই খুব উঁচু মানের শিল্পী। ওঁরা কী করেছেন বা করেননি, তা আমার জানার কথা নয়। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, আমাকে অবহেলা করা হয়েছে। যেটা কোনও শিল্পীর সঙ্গেই হওয়া উচিত নয়।’’
হিন্দি সিনেমার গানে গুরুত্ব না পেয়ে কিন্তু থেমে থাকেনি বাণীর কেরিয়ার। তিনি দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে খ্যাতি অর্জন করেন। একের পর এক গানে মুগ্ধ করেন শ্রোতাদের। বাণী জয়রামের কণ্ঠে এক সময় মজে ছিল গোটা দক্ষিণ ভারত।
২০২৩ সালেই পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন বাণী। সারা জীবনে আরও একাধিক পুরস্কার তিনি লাভ করেছেন। তামিল, তেলুগু, মালয়ালম, সব ভাষাতেই সেরা নেপথ্য কণ্ঠের পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
বাণী এবং তাঁর ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রকাশ্যেই মুখ খুলেছিলেন লতা। একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, একাধিক সঙ্গীতশিল্পী তাঁর বিরুদ্ধে আধিপত্য ফলানোর অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী?
জবাবে লতা বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা এমন অভিযোগ করেন, তাঁরা ভুল। আমাকে তো কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিলেন, আমি নাকি অন্য শিল্পীদের গানের যন্ত্রপাতিও নষ্ট করে দিতাম! কিন্তু আমি কেন এ সব করতে যাব? অন্য শিল্পীরা কে কী করছেন, তা নিয়ে আমি কখনওই মাথা ঘামাইনি।’’
এর পরেই বাণীর প্রসঙ্গে আসেন লতা। তিনি বলেন, ‘‘আমি সবসময় বাণী জয়রামের প্রশংসা করেছি। তা-ও তিনি বলে বেড়ান আমি নাকি ওঁকে গাইতে দিইনি। এটা একেবারেই ঠিক নয়।’’
লতা যা-ই বলুন, বাণীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে গুজব ডালপালা মেলতে বেশি সময় নেয়নি। ইন্ডাস্ট্রিতে এই দুই শিল্পীর মধ্যে যে তিক্ততা রয়েছে, তা সহজেই অনুমান করে নিয়েছিলেন অনুরাগীরা।
লতা এবং বাণীর এই দ্বৈরথ নিয়ে পরবর্তী কালে একটি ছবিও তৈরি করা হয়। ২০১৫ সালের ‘ব্লু মাউন্টেন’ (ভারতে মুক্তি পায় ২০১৭ সালে) ছবিতে এই দুই শিল্পীর কথাই তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। ছবির নির্মাতারা যদিও সরাসরি তা স্বীকার করেননি।
শনিবার সদ্য পদ্মভূষণ সম্মান প্রাপ্ত বাণীর মৃত্যুকে কিছুটা আকস্মিকই বলা চলে। তাঁর বাড়ির পরিচারিকা জানিয়েছেন, বয়স বাড়লেও বাণী সুস্থই ছিলেন। তাঁকে অভিনন্দন জানাতে বাড়িতে মাঝেমাঝেই অতিথিরা আসতেন। তা নিয়েই মেতে ছিলেন প্রবীণ শিল্পী। তাঁর এমন মৃত্যু তাই মেনে নিতে পারছেন না পরিজনেরা।