উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজের কাছে কৌশাম্বী জেলা হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ড। ডিসেম্বর শুরুর ঠান্ডায় সেই ওয়ার্ডেরই একটি বিছানার উপর শাল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ১৩ বছরের নাবালিকা।
মাথায় বালিশটুকুও নেই। শূন্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে সিলিংয়ের দিকে। মেয়েটি অপেক্ষা করছে। গর্ভপাতের অপেক্ষায় দীর্ঘ দিন ধরে তার ঠিকানা হাসপাতালের ওই বিছানা।
১৩ বছরের ওই নাবালিকা ধর্ষণের শিকার। কৌশাম্বীর কমলপুর এলাকার বাসিন্দা শিব মুরাত পাসি নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ আছে।
পরে নির্যাতিতাকে খুনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে শিবের বিরুদ্ধে। বর্তমানে অভিযুক্ত জেল হেফাজতে বন্দি।
এ দিকে ছয় মাসের ভ্রূণ নাবালিকার গর্ভে। অগস্ট মাসে যখন ধর্ষণের কথা প্রকাশ্যে আসে তখন ইতিমধ্যেই সে ১৮ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা। চিকিৎসকদের কাছে গর্ভপাতের অনুরোধ জানিয়ে নাবালিকাকে কৌশাম্বী হাসপাতালে ভর্তি করেন তার বাবা।
যখন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তখন সে ২৪ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা। ডাক্তারদের কাছে গর্ভপাতের অনুরোধ করলেও তাঁরা রাজি হননি।
চিকিৎসকরা তাঁর বাবাকে সাফ জানিয়ে দেন, ভ্রূণের গর্ভপাতের জন্য আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। তবেই সম্ভব গর্ভপাত।
নাবালিকার বাবা যখন গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে জেলা আদালতের দ্বারস্থ হন, তখন আরও কিছুটা সময় পেরিয়েছে।
নাবালিকার গর্ভের ভ্রূণ তখন ২৯ সপ্তাহে। নির্যাতিতার বাবার আর্জি শুনে ১৫ অক্টোবর কৌশাম্বী জেলা হাসপাতালের প্রধান মেডিক্যাল অফিসার সুষ্পেন্দ্র কুমারকে ডেকে ডাক্তারদের একটি মেডিক্যাল দল গঠন করার নির্দেশ দেয় আদালত।
নির্দেশ দেওয়া হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী গর্ভপাতের ব্যবস্থা করে আদালতকে জানাতে।
প্রধান মেডিক্যাল অফিসার ২ নভেম্বর আদালতকে জানান, ওই নাবালিকা বর্তমানে ৩১ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা। সহজ পদ্ধতিতে গর্ভপাতের সময় পেরিয়েছে। এখন গর্ভপাত করতে অনেক সমস্যা। সেই পরিকাঠামো কৌশাম্বী জেলা হাসপাতালে নেই।
এখন নাবালিকার গর্ভপাত করতে হলে তাকে প্রয়াগরাজের স্বরূপ রানি নেহরু হাসপাতালে পাঠাতে হব বলেও আদালতে জানান প্রধান মেডিক্যাল অফিসার।
সুষ্পেন্দ্র নিউজলন্ড্রিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, “আমাদের গর্ভপাত করা উচিত কি না, সে বিষয়ে আদালতের আদেশ স্পষ্ট নয়। কোনও ক্ষেত্রেই আমরা গর্ভপাত করতে পারি না কারণ আমাদের হাসপাতালে সেই সুযোগ-সুবিধা নেই। নির্যাতিতা তার প্রাণও হারাতে পারে। তবুও যদি পরিবারের সদস্যরা গর্ভপাত করতে চান, তা হলে তাঁরা প্রয়াগরাজের স্বরূপ রানি হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।’’
যদিও চিকিৎসকদের কথা মানতে নারাজ নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যরা। বরং মেয়ের গর্ভপাতে দেরি হওয়ার জন্য কৌশাম্বী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করেছেন তাঁরা।
নাবালিকার বাবা বলেন, “প্রথমে আমাকে বলা হয়, গর্ভপাতের জন্য আদালত থেকে অনুমতি আনতে। আমি অনুমতি আনার পর এখন বলা হচ্ছে এখানে মেয়ের গর্ভপাত সম্ভব নয়। আমাদের স্বরূপ রানি হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি ওই হাসপাতালেও গর্ভপাত করতে অস্বীকার করে? এর পর কোথায় যাব?’’
একই অভিযোগ ওই নাবালিকার আইনজীবী গোবিন্দ প্রতাপ সিংহেরও। তাঁর দাবি, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখন দায় ঝেড়ে ফেলতেই এ সব কথা বলছে।
পাশাপাশি মেয়ের বিয়ে নিয়েও চিন্তিত নাবালিকার বাবা। মেয়ে কুমারী মা হলে তাকে কেউ বিয়ে করবে না! এই চিন্তাতেই তাঁর রাতের ঘুম উড়েছে। সেই জন্যই গর্ভপাত করার জন্য তিনি তৎপর।
এই প্রসঙ্গে নাবালিকার বাবা বলেন, ‘‘আমাদের মতো মানুষের প্রতি কারও কোনও সহানুভূতি নেই। আমি এক জন দরিদ্র মানুষ। আমার কাছে টাকা নেই। প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে আদালতে ছুটছি। আমি যদি আমার মেয়ের বিচারের জন্য এ দিক-ও দিক ছুটতে থাকি, তা হলে পরিবার কী করে সামলাব? আমরা চাই না আমার মেয়ের কোনও অবাঞ্ছিত সন্তানের জন্ম দিক। ওর মাত্র ১৩ বছর বয়স। এখন সন্তানের জন্ম দিলে আমার মেয়েকে বিয়ে কে করবে?’’
তবে যাকে নিয়ে এত তরজা, দীর্ঘ দিন সেই নাবালিকার দিন কাটছে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। শাল গায়ে দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে সে অপেক্ষা করছে বাড়ি ফেরার।