ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু জেট থেকে শুরু করে ‘হাইপারসোনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র— নানা দিক দিয়ে সেনার শক্তি বাড়িয়েই চলেছে চিন। বেজিঙের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমেরিকার কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। তার তাই ড্রাগনকে চাপে রাখতে অত্যাধুনিক বোমারু বিমান নির্মাণে গতি আনার সিদ্ধান্ত নিল ওয়াশিংটন। দুই মহাশক্তিধরের এ-হেন অস্ত্র প্রতিযোগিতা পরিস্থিতিকে জটিল করবে বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
বিশ্লেষকদের দাবি, গত কয়েক বছর ধরেই মাঝারি পাল্লার লড়াকু জেট নির্মাণে বেশি করে মন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্য দিকে একই ধরনের যুদ্ধবিমান বিপুল সংখ্যায় তৈরি করছে চিনও। ফলে সংখ্যার নিরিখে কমছে ফারাক। আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন জানিয়েছে, এই অবস্থায় একমাত্র সামঞ্জস্য আনতে পারে বোমারু বিমান বি-২১ রাইডার। আর তাই দ্রুত সেটি বায়ুসেনার হাতে তুলে দিতে চাইছেন তাঁরা।
প্রসঙ্গত, চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ বায়ুসেনার কাছে কোনও বোমারু বিমান নেই, এ কথা ভাবলে ভুল হবে। এইচ-২০ নামের একটি বোমারু বিমান ব্যবহার করে ড্রাগন ফৌজ। ধারে ও ভারে বি-২১ রাইডারকে তার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী বলে দাবি করেছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ১০ জানুয়ারি এই ইস্যুতে ‘এয়ার অ্যান্ড স্পেস ফোর্স ম্যাগাজ়িন’কে একটি সাক্ষাৎকার দেন আমেরিকার বায়ুসেনা সচিব ফ্র্যাঙ্ক কেন্ডাল। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘চিনকে মোকাবিলার জন্য আমাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। যুদ্ধে একক ক্ষমতায় ‘খেলা ঘোরানো’র ক্ষমতা রয়েছে বি-২১ রাইডারের। জরুরি ভিত্তিতে এর উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসে গিয়েছে।’’
যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ‘নর্থরপ গ্রুমম্যান’ হল বি-২১ রাইডার বোমারু বিমানের নির্মাণকারী সংস্থা। এখনও পর্যন্ত এই যুদ্ধবিমানের মোট তিনটি ‘প্রোটোটাইপ’ তৈরি করেছে তারা। সূত্রের খবর, বছরে মোট সাতটি বোমারু বিমান নির্মাণের ক্ষমতা রয়েছে নর্থরুপের।
বি-২১ রাইডার প্রকৃতপক্ষে একটি ষষ্ঠ প্রজন্মের বোমারু বিমান। লম্বা দূরত্ব উড়ে গিয়ে হামলা করার ক্ষমতা রয়েছে এই যুদ্ধবিমানের। এর নকশা বেশ অদ্ভুত। লড়াকু বিমানটির লেজের অংশ প্রায় নেই বললেই চলে। এর পাখা চওড়া ও ত্রিভুজাকার।
আমেরিকার এই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানটি স্টেল্থ প্রযুক্তির বলে জানিয়েছে নির্মাণকারী সংস্থা। অর্থাৎ, সহজে একে চিহ্নিত করতে পারবে না কোনও রাডার। প্রথাগত এবং পারমাণবিক, দু’ধরনের বোমা নিয়েই উড়তে পারে বি-২১ রাইডার। প্রায় ৯,১০০ কেজি ওজনের হাতিয়ার নিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা করার ক্ষমতা রয়েছে এই লড়াকু বিমানের।
বর্তমানে আমেরিকার বায়ুসেনায় রয়েছে একাধিক বোমারু বিমান। এর মধ্যে বি-২ স্পিরিটকেই সবচেয়ে শক্তিশালী বলে মনে করা হয়। পেন্টাগন জানিয়েছে, ভবিষ্যতে বি-২ স্পিরিটের জায়গা নেবে বি-২১ রাইডার।
একটা সময়ে বোমারু বিমানের বহরকে ছোট রাখার সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা। আর তাই প্রাথমিক ভাবে ১৩২টি বি-২ স্পিরিট নির্মাণের কথা থাকলেও এটি মাত্র ২১টি তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু চিনের ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধিতে সেই সিদ্ধান্ত থেকে ওয়াশিংটন সরে এসেছে বলে স্পষ্ট করেছেন বায়ুসেনা সচিব কেন্ডাল।
সূত্রের খবর, গত বছর (পড়ুন ২০২৪) বি-২১ রাইডার নির্মাণের বরাত দেয় পেন্টাগন। সেই কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে ‘নর্থরপ’। প্রথম পর্যায়ে এই শ্রেণির পাঁচটি বোমারু বিমান আমেরিকার বায়ুসেনার হাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি তুলে দেবে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝি বিমানগুলি পেতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ-যোদ্ধারা।
আমেরিকার প্রতিরক্ষা দফতরের সাবেক শীর্ষকর্তা উইলিয়াম লাপ্ল্যান্ট জানিয়েছেন, ভবিষ্যতের বড় যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে বি-২১ নির্মাণের বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। ১০০টি এই ধরনের বোমারু বিমান তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির উপর বিচার করে এই সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে।
‘এয়ার অ্যান্ড স্পেস ফোর্স ম্যাগাজ়িন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সব মিলিয়ে বর্তমানে আমেরিকার বায়ুসেনার হাতে রয়েছে ১৫৭টি বোমারু বিমান। অন্য দিনে ড্রাগন ফৌজে এই শ্রেণির যুদ্ধবিমানের সংখ্যা ১৮০। বি-২১ রাইডারের দ্রুত নির্মাণের মাধ্যমে এই ফারাক ঘোচাতে চাইছে ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুসেনা সচিব কেন্ডাল জানিয়েছেন, ২০৩০ সালে চিনের যুদ্ধবিমানের বহর আমাদের সমান হবে। ফলে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার নিরাপত্তা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ওয়াশিংটনকে এর মূল্য চোকাতে হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ২৬ ডিসেম্বর আধুনিক চিনের রূপকার তথা কিংবদন্তি চেয়ারম্যান মাও-জে দঙের জন্মদিনে সিচুয়ান প্রদেশের চেংডুতে ‘ঝুহাই এয়ার শো’র আয়োজন করে চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএর বিমানবাহিনী। সেখানেই প্রথম বার ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু জেট জে-৩৬কে আকাশে উড়িয়ে রীতিমতো সবাইকে চমকে দেয় বেজিং। বলা বাহুল্য ওই ঘটনার পর আমেরিকার প্রতিরক্ষা দফতরের কর্তাব্যক্তিদের কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ।
‘ইউরেশিয়ান টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু বিমান তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বেজিং। মাঝে ২০১৯ সালে এই প্রকল্পে আরও গতি আনার নির্দেশ দেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। অবশেষে ২০২৪ সালের বিদায়বেলায় ক্ষমতা প্রদর্শন করেন তিনি।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ দিন ধরেই ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির পরিকল্পনা করছে আমেরিকা। কিন্তু, এখনও তাতে সাফল্য পায়নি যুক্তরাষ্ট্র। নতুন প্রজন্মের অত্যাধুনিক লড়াকু বিমান হাতে পাওয়ায় যুদ্ধের ময়দানে ড্রাগন বেশ কিছুটা এগিয়ে গেল বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
পৃথিবীর প্রায় সমস্ত লড়াকু বিমানে লেজের মতো একটি অংশ থাকে। ‘জে-৩৬’ জেটে সেটি রাখেননি বেজিংয়ের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। মাঝ আকাশের ‘ডগফাইটে’ যুক্তরাষ্ট্রের জেটগুলিকে চিনা যুদ্ধবিমানটি মাত দিতে পারে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
সূত্রের খবর, নতুন প্রজন্মের চিনা যুদ্ধবিমানে রয়েছে তিনটি ইঞ্জিন। ফলে পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু উড়ানগুলির থেকে এর গতি অনেকটাই বেশি। ‘জে-৩৬’ জেটে রয়েছে টার্বোফ্যান ইঞ্জিন। লেজের মতো অংশ না-থাকায় কোনও ভাবেই একে চিহ্নিত করতে পারবে না রাডার। অর্থাৎ, যুদ্ধবিমানের ‘স্টেলথ’ শক্তি বাড়িয়েছে বেজিং।
এ ছাড়া, এক বার জ্বালানি ভরে দীর্ঘ সময় আকাশে থাকতে পারবে ‘জে-৩৬’। পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু বিমানগুলির তুলনায় এর হাতিয়ার বহনক্ষমতাও বেশি। আবার প্রয়োজনে মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরতে পারবেন ‘জে-৩৬’ জেটের পাইলট। শূন্যে কসরত দেখানোর ক্ষেত্রেও এর দক্ষতা আমেরিকা বা রাশিয়ার অতি শক্তিশালী যুদ্ধবিমানগুলির থেকে কোনও অংশ কম নয়।
পাশাপাশি, জে-৬ নামের একটি বোমারু বিমান ব্যবহার করে পিএলএ বায়ুসেনা। সোভিয়েত যুগের রুশ বোমারু বিমান টুপোলেভ টিইউ-১৬-এর আদলে সেটিকে বেজিং তৈরি করেছে বলে দাবি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের।
এ বছরের (পড়ুন ২০২৫) ৬ জানুয়ারি চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) বায়ুসেনার শক্তি নিয়ে আশঙ্কার কথা বলতে শোনা গিয়েছে আমেরিকার এডওয়ার্ড এয়ারফোর্স ঘাঁটির ৪১২তম টেস্ট উইংয়ের কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডগ উইকার্টের গলায়। ‘ব্যাক-ইন-দ্য-স্যাডল ডে’ অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধবিমানের দিক থেকে অপ্রত্যাশিত উন্নতি করেছে চিন।’’
উইকার্টের দাবি, ‘‘কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের এলাকায় লড়াকু জেট মোতায়েনের নিরিখে আমেরিকাকে পিছনে ফেলতে চলেছে চিন। ২০২৭ সালের মধ্যে বেজিং এবং ওয়াশিংটনের যুদ্ধবিমানের সংখ্যার অনুপাত দাঁড়াবে ১২ বনাম এক।’’ এতে আগ্রাসী ড্রাগনকে মোকাবিলা করা যে যথেষ্টই কঠিন হবে, তা স্পষ্ট করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওই বায়ুসেনা অফিসার।
এর পাশাপাশি সমুদ্রে নজরদারির ক্ষেত্রে লালফৌজ যে আমেরিকার নৌসেনার থেকে এগিয়ে রয়েছে, তা বকলমে স্বীকার করে নিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল উইকার্ট। তাঁর কথায়, ‘‘ওই এলাকায় পিএলএর ২২৫টি বোমারু বিমান অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে প্রভাব বাড়াতে বিমানবাহী রণতরী, উভচর হামলাকারী যুদ্ধজাহাজ এবং একাধিক ডুবোজাহাজকে কাজে লাগাচ্ছে বেজিং।’’
এ ছাড়া পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের স্বল্পতার কথাও বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওই পদস্থ বায়ুসেনা অফিসার। উইকার্টের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বেজিং এবং ওয়াশিংটনের হাতে থাকা এই ধরনের লড়াকু জেটের সংখ্যার অনুপাত দাঁড়িয়েছে পাঁচ বনাম তিন। সমুদ্রে নজরদারি বিমানের ক্ষেত্রে সেটি তিন বনাম একে গিয়ে ঠেকেছে।
চিনা সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘গ্লোবাল টাইম্স’ জানিয়েছে, এ বছরের (পড়ুন ২০২৫) জানুয়ারি মাসে আকাশ থেকে আকাশ একটি ‘হারপারসোনিক’ ক্ষেপণাস্ত্রের চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র আমেরিকার বি-২১ রাইডারকে ধ্বংস করার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।