মাটির নীচে রয়েছে কুবেরের ধনভান্ডার। লন্ডনের থ্রেডনিডেল স্ট্রিটে মাটির নীচে সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধা রয়েছে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সোনা জমা রয়েছে ওই ভল্টে। বিশেষ অনুমতি ছাড়া কেউ ওই ভল্টে যেতে পারেন না। একমাত্র ইংল্যান্ডের রাজা বা রানিই ওই ভল্টে যে কোনও সময়ে যেতে পারেন এবং জমা সোনা দেখতে পারেন।
২১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের সোনা জমা রয়েছে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের সুদৃঢ় সুরক্ষিত ভল্টে। সেখানে সোনা জমা রাখে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ও বেসরকারি সংস্থা। মজুত সেই সোনা এ বার ধীরে ধীরে নিজেদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন সোনা বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত সংস্থা এবং ব্যাঙ্কগুলি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য শুল্কনীতির আশঙ্কাই এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশ। ইতিমধ্যে নিউ ইয়র্কে বিপুল সোনা মজুত করতে শুরু করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ। ফরচুনের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গিয়েছে, নভেম্বর থেকে সেই ব্যাঙ্কে জমা সোনার পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসন আমদানিতে শুল্ক আরোপ করতে পারে, এই আশঙ্কায় ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড থেকে সোনা দ্রুত আমেরিকায় ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সেই কারণে ইংল্যান্ডের বাজারে সোনার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা যে ভাবে বাড়ছে, তাতে এখন দেশের সোনা দেশে রাখাই শ্রেয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক কারবারিরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্রাম্পের শুল্ক-কাঁটা।
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ট্রাম্প। এর পরই দুই পড়শি দেশ কানাডা এবং মেক্সিকোর উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন তিনি। চিনের উপর চাপান ১০ শতাংশ শুল্ক। ইস্পাত এবং অ্যালমুনিয়াম আমদানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্কের কথা ঘোষণা করেছেন তিনি।
ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়ামের উপর শুল্ক বৃদ্ধির জেরে এগুলির দাম মার্কিন বাজারে চড়তে শুরু করেছে। আগামী দিনে সোনার ক্ষেত্রে তিনি একই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সে দেশের ব্যবসায়ীরা। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ঘোষণার ফাঁকেই নিউ ইয়র্কে চড়চড় করে বাড়ছে সোনার দাম, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সোনার চাহিদাও।
ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের ডেপুটি গভর্নর ডেভ র্যাম্সডেন সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফকে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, লন্ডন ও নিউ ইয়র্কে সোনার দামে বেশ কিছুটা ফারাক হওয়ায় আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থা ভল্ট থেকে জমানো সোনা নিয়ে যেতে শুরু করেছেন। নিউ ইয়র্কে সোনার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড থেকে সোনা ফেরতের চাহিদাও সমানুপাতিক হারে বেড়ে গিয়েছে।
নিউ ইয়র্কের ফিউচার বাজারে সোনার দাম লন্ডনের সোনার বাজারের তুলনায় বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা আটলান্টিকের ও পার (ইংল্যান্ড) থেকে সোনা সংগ্রহ করছেন। লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের দু’টি প্রধান বাজার। সোনার দাম নিউ ইয়র্কে বেড়ে যাওয়ায় সেখানে ব্যবসায়ীরা বেশি করে সোনা মজুত করছেন বলে জানা গিয়েছে।
গত নভেম্বর থেকে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও জানান ডেভ। এই বছর নিউ ইয়র্কে সোনার দাম ১১ শতাংশ বেড়ে বৃহস্পতিবার প্রতি ট্রয় আউন্সে (৩১ গ্রাম) ২,৯৩৫ ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকেরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে দাম শীঘ্রই রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলবে। ৩ হাজার ডলারে পৌঁছোতে পারে সোনার দাম। এর ফলে ভবিষ্যতে লন্ডনের ভল্ট থেকে সোনা কমে যাওয়ার পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবদনে বলা হয়েছে, ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের থেকে সোনা তোলার জন্য অপেক্ষার সময়কাল হঠাৎ করেই বেড়ে চার সপ্তাহে পৌঁছে গিয়েছে। কয়েক দিন আগেও এই সময়সীমা তুলনামূলক ভাবে অনেক কম ছিল।
ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে যে হারে সোনা তুলে নিউ ইয়র্কে পাঠানোর হিড়িক পড়েছে তাতে এই সময়সীমা আট সপ্তাহ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন এক বিশেষজ্ঞ।
গত কয়েক মাসে আনুমানিক ৮ হাজার সোনার বাট রফতানি করা হয়েছে। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের মোট মজুতের প্রায় ২ শতাংশ নিউ ইয়র্কে পাঠানো হয়েছে।
বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হিসাবের বাইরেও নিউ ইয়র্কে আরও সোনা ঢুকেছে। সেগুলি এইচএসবিসি ও জেপি মর্গ্যানের মতো ব্যক্তিগত ভল্টে সংরক্ষিত হয়ে থাকতে পারে। তবে এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি বেসরকারি ভল্ট কর্তৃপক্ষ।
জেপি মরগ্যান এবং এইচএসবিসির মতো প্রধান ব্যাঙ্কগুলি লোকসান মেটাতে আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে সোনা উড়িয়ে আনছে বলে খবর। জেপি মরগ্যান একাই এই মাসেই ৪০০ কোটি ডলারের সোনা সরবরাহের পরিকল্পনা নিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।
নভেম্বরে ট্রাম্পের জয়ের পর থেকে এই সোনার বেশির ভাগই স্থানান্তরিত হয়েছে নিউ ইয়র্কে। ব্যবসায়ীরা নিউ ইয়র্কের কমেক্স কমোডিটি এক্সচেঞ্জে ৩৯৩ মেট্রিক টন সোনা ফেরত এনেছেন বলে খবর।
অন্য দেশের সোনা রাখার ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য জায়গা ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড। ওই ব্যাঙ্কের বেশ কয়েকটি ভূগর্ভস্থ ভল্ট রয়েছে। ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের সোনা সেখানে ভাড়ার বিনিময়ে রাখা হয়। সোনা গচ্ছিত রাখার জন্য ইংল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে বিপুল অঙ্কের ভাড়া দিতে হয়।