‘শখের প্রাণ গড়ের মাঠ’-বাঙালির প্রিয় এই প্রবাদ এসেছে যেখান থেকে, সেই কলকাতার ময়দানকে বলা হয় শহরের ফুসফুস। ব্রিটিশ আমলে এই অংশ ছিল ঘন জঙ্গল। সেখান থেকে কী করে আজকের চেহারায় এল কলকাতা ময়দান?
আজকের কলকাতা ময়দান ছিল সেকালের গোবিন্দপুরের অংশ। জনবসতি বলতে এক কোণে একটি জীর্ণ গ্রাম। বাকি জমি জুড়ে ঘন বন আর মাঝে মধ্যে চাষের খেত। মূলত বাঘ-শিয়ালের বাসা, সাধু সন্ন্যাসীদের তপস্যার জায়গা আর ডাকাতদের আস্তানা। এই ছিল সেখানকার ছবি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন বড় একটা পা রাখতেন না সেখানে।
এই জঙ্গলেই গড় বানানোর কথা ভাবলেন ব্রিটিশরা। কলকাতায় তাঁদের ঘাঁটি মজবুত করতে হুগলি নদীর তীরে দুর্গের প্রয়োজনীয়তা প্রথম বোধ করেছিলেন উইলিয়ম হেজেস। ১৬৮২-১৬৮৪ তিনি ছিলেন বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মী। পরে জোব চার্নকের মৃত্যুর পরে ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এসেছিলেন স্যর জন গোল্ডসবরো। তখন ক্ষমতার মসনদে মুঘল বংশ। তাঁদের অনুমতি না নিয়েই হুগলি নদীর তীরে পছন্দসই জায়গা মাটির দেওয়ালে ঘিরে দেওয়া হল গোল্ডসবরোর নির্দেশে।
হুগলি নদীর তীরে পছন্দ করা নির্দিষ্ট জায়গায় ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হল গড়। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ সম্রাট তৃতীয় উইলিয়ামের নামে নামকরণ হল, ফোর্ট উইলিয়াম। পরে ধীরে ধীরে শাসকের সঙ্গে দুর্গে যোগ হয়েছে আরও পরিসর। বাংলায় ব্রিটিশ বণিকদের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হওয়ার মূল কেন্দ্র ছিল এই দুর্গ।
এই দুর্গকে তাঁর আক্রমণের মূল লক্ষ্য করেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ইংরেজদের সঙ্গে দৌত্যে ব্যর্থ সিরাজ কলকাতা আক্রমণে উদ্যত হলেন।১৭৫৬ সালের ১৬ জুন ৩০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে সিরাজ হাজির হলেন কলকাতার উপকণ্ঠে। ১৮ জুন তাঁর বাহিনীর কাছে লালদিঘির যুদ্ধে পরাজিত হল ব্রিটিশরা। ফোর্ট উইলিয়াম দখল করলেন সিরাজ। কলকাতার নাম রাখলেন ‘আলিনগর’।
ব্রিটিশদের গর্বের ফোর্ট উইলিয়ামে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল সিরাজের বাহিনী। এই সময়েই ঘটে বিতর্কিত ব্ল্যাকহোলকাণ্ড। তবে ব্ল্যাকহোল বা অন্ধকূপ হত্যা হোক বা না হোক, এই আক্রমণ সিরাজের পতন ডেকে আনে।
সিরাজকে পদানত করলেও ব্রিটিশরা তাদের ফোর্ট উইলিয়ামকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি। নতুন দুর্গের জন্য জায়গা নির্বাচন করা হয়। পলাশীর যুদ্ধের পরে মীর জাফরের সেলামির টাকায় গোবিন্দপুরের ওই জীর্ম গ্রামের বসতি উঠিয়ে তৈরি হয় নতুন ফোর্ট উইলিয়াম বা নতুন গড়। গ্রামবাসীদের স্থানান্তরের জন্য নতুন জমি দেওয়া হয় তালতলা, কুমারটুলি, শোভাবাজারের মতো তুলনামূলকভাবে তৎকালীন কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়।
এই গড়ের জন্যই ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে এলাকার নাম হয় ‘গড়ের মাঠ’। তার আগেই বন কেটে সাফ করে পুরো জায়গাটা মাঠ করে ফেলেছিল ব্রিটিশরা। এই বৃক্ষছেদনের পিছনে মহামারীর প্রসঙ্গ জড়িয়ে আছে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় মহামারী দেখা দিয়েছিল। লর্ড ক্লাইভ তখন শহরের স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায় গাছ কাটার নির্দেশ দেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফরমান জারি করে। সেখানে বলা ছিল, সে দিন থেকে কোম্পানির এলাকায় যে কেউ নিজের খরচে ফলের গাছ ছাড়া অন্য যে কোনও গাছ কেটে ফেলতে পারে। তাতে কোম্পানির আপত্তি নেই। সেদিন থেকেই ব্রিটিশ প্রশ্রয়ে অরণ্যের দখল নিতে থাকে নতুন নগর।
দ্রুত গাছ কেটে এগোতে থাকে শহর। ধর্মের নামে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে বট, অশ্বত্থের মতো গাছ। সে টুকু না হলে হয়তো গড়ের মাঠ আরও বেশি বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ত। তবে, কলকাতা প্রসারিত হওয়ার পরে ব্রিটিশরা সৌন্দর্যায়নের জন্য নানা ধরনের গাছ লাগিয়েছিল।
গড়ের মাঠের কাছেই ছিল সে কালের চৌরঙ্গি গ্রাম। যোগী সাধক চৌরঙ্গি গিরির নাম থেকেই সে জনপদের নামকরণ।তবে সেই গ্রাম আর হুগলি নদীর মাঝে অন্তরায় ছিল ঘন জঙ্গল। সেই বন ছিল বাঘের ডেরা। ক্রমে সেই জঙ্গলও কেটে সাফ করা হয়। সেই জায়গাও অন্তর্ভুক্ত হয় গড়ের মাঠের মধ্যে।
অতীতের জঙ্গলঘেরা জায়গা থেকে গড়ে ওঠা নতুন গড়ের মাঠ হয়ে ওঠে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়দের প্রিয় জায়গা। প্রান্তবাসীদের আগেই সরানো হয়ে গিয়েছিল। ক্রমে শ্বেতাঙ্গদের দাপটে সরে যেতে থাকেন বাঙালি ধনীশ্রেণিও। দেব পরিবার সরে যায় শোভাবাজারে। টেগোররা ভদ্রাসন করে জোড়াসাঁকো আর পাথুরিয়াঘাটায়। ঘোষালরা চলে যায় ভূকৈলাস, বা আজকের খিদিরপুরে।
পরবর্তী কালে ক্রমে গড়ের মাঠের নাম হয় কলকাতা ময়দান। একে ঘিরেই গড়ে ওঠে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রাজভবন, ইডেন গার্ডেন্স, ভারতীয় যাদুঘর, বিড়লা প্ল্যানোটরিয়াম, নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম, শহিদ মিনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য।
ব্রিটিশ শাসনে গড়ের মাঠকে সাজানো হয়েছিল তাদের বীরদের মূর্তিতে। লর্ড কার্জন, লর্ড মিন্টো, লর্ড নর্থব্রুক, লর্ড ক্যানিংয়ের মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল সেখানে। স্বাধীন ভারতে কলকাতায় ময়দানে স্থাপিত হয় মহাত্মা গাঁধী, রাজা রামমোহন রায়, চিত্তরঞ্জন রায়, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্রবসু, শ্রী অরবিন্দ, মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-সহ স্মরণীয় ভারতীয়দের মূর্তি।
ঋণস্বীকার: ‘কলকাতা’: শ্রীপান্থ, ‘কলিকাতা দর্পণ’: রাধারমণ মিত্র, কলিকাতার ইতিবৃত্ত ও অন্যান্য রচনা: প্রাণকৃষ্ণ দত্ত (দেবাশিস বসু সম্পাদিত), (ছবি: আর্কাইভ, শাটারস্টক ও সোশ্যাল মিডিয়া।)