কাঁচা সোনার মতো গায়ের রং। তার উপর কালো কালির ডোরাকাটা। এ-হেন ভারতীয় বাঘের উপর ‘শকুন-দৃষ্টি’তে তাকিয়ে চিন। হাড়-মাংস-চামড়ার লোভে চোরাশিকারিদের দেদার উৎসাহ দিচ্ছে ড্রাগন। সঙ্গে দোসর হিসাবে জুটেছে ভিয়েতনাম। বিষয়টি নজরে পড়ায় বেজায় উদ্বিগ্ন নয়াদিল্লি। এতে বাঘের সংখ্যা হ্রাসের আশঙ্কা করে রীতিমতো আতঙ্কিত বন দফতরের দুঁদে আমলা থেকে ফরেস্ট রেঞ্জাররা।
এ দেশ থেকে বাঘের হাড়-মাংস-চামড়া চিন বা ভিয়েতনামে পাঠাতে সাধারণত উত্তর-পূর্ব ভারতকেই বেছে থাকে পাচারকারীরা। তাদের পছন্দের রাস্তা হল অসম থেকে মিজ়োরাম হয়ে মায়ানমার দিয়ে সোজা চিন বা ভিয়েতনাম। ২০২৩ সালের জুনে বিষয়টি প্রথম বার নজরে আসে গুয়াহাটি পুলিশের। তদন্তে নেমে চোখ কপালে ওঠে তাঁদের।
অসমের গুয়াহাটিতে রয়েছে কামাখ্যা দেবীর মন্দির। প্রতি বছর অম্বুবাচীর সময় সেখানে কয়েক গুণ বেড়ে যায় ভক্তদের ভিড়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে সাধু-সন্তের দল। ২০২৩ সালের জুনে এই সুযোগকে কাজে লাগায় পাচারকারীরা। পুণ্যার্থীদের ভিড়ে মিশে গিয়ে ব্যাঘ্র চর্ম ও হাড় পাচারের পরিকল্পনা করে তারা। যদিও শেষরক্ষা হয়নি।
সে বার অম্বুবাচীর সময় পাচারকারীদের একটি দলকে হাতেনাতে পাকড়াও করে গুয়াহাটি পুলিশ। তাদের থেকে উদ্ধার হয় একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘের চামড়া ও ১৭ কেজি হাড়। পাচারকারীদের দলটিতে ছিলেন দুই মহিলা, দু’জন পুরুষ এবং একটি শিশু। ধৃতদের মধ্যে এক জনের নাম মায়া দেবী (৪০)। পুলিশ সূত্রে খবর, তিনি ওই বাঘের চামড়া এবং হাড় মেঘালয়ে কারও কাছে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন।
পরবর্তীকালে এই ঘটনার তদন্তে নামে অসমের কামরূপের রেঞ্জ অফিসার প্রাঞ্জল বড়ুয়া। আর সেখানেই একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে বন দফতরের হাতে। গ্রেফতার হওয়া পাচারকারী দলটি উত্তর ভারতের যাযাবর জাতি গোষ্ঠীভুক্ত বলে জানতে পারেন তিনি। উদ্ধার হওয়া ব্যাঘ্র চর্মের ফরেন্সিক পরীক্ষা করা হয়। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, পাচারের জন্য নিহত হলুদ ডোরাকাটাটি ছিল মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধেরি টাইগার রিজ়ার্ভের বাসিন্দা। সেখানকার আরও দু’টি বাঘ নিখোঁজ রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীকালে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন প্রাঞ্জল। তাঁর কথায়, ‘‘ফরেন্সিক রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর বেশ অবাক হয়েছিলাম। এ দেশের বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে কয়েক দশক লেগে গিয়েছে। এর জন্য সরকারি তরফে কম টাকা খরচ হয়নি। আপাতত একটি স্বস্তিজনক জায়গায় পৌঁছতে পেরেছি আমরা।’’ আর তাই গুয়াহাটির ঘটনাকে ‘অশনিসঙ্কেত’ হিসাবে দেখছেন তিনি।
এ ব্যাপারে তাই এতটুকু দেরি করেনি অসম সরকার। দ্রুত ব্যাঘ্র চর্ম ও হাড় পাচার সংক্রান্ত মামলাটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরো’ বা ডব্লুসিসিবির কাছে পাঠায় হিমন্ত বিশ্বশর্মার সরকার। কিছু দিনের মধ্যেই মহারাষ্ট্রের একটি চক্রকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় তারা। ধৃতদের মধ্যে দিল্লির দ্বারকা এলাকার বাসিন্দা মিশ্রম জাখাদের নামও ছিল। তাঁকে চোরাশিকারিদের চাঁই বলে দাবি করেছে ডব্লুসিসিবি।
কিন্তু, এই ঘটনার তদন্তে আরও কিছু চমকে দেওয়ার মতো তথ্য হাতে পায় গুয়াহাটির বন দফতর। মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর এবং মধ্যপ্রদেশের জবলপুরে দু’টি বাঘের চোরাশিকার এবং তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বার করে তারা। অন্য দিকে এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসে মহারাষ্ট্র সরকারও। সম্প্রতি বাঘের মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে দেবেন্দ্র ফডণবীস প্রশাসন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ২৪ দিনে মহারাষ্ট্রে ১২টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, এর মধ্যে তিনটি হলুদ ডোরাকাটার হত্যার নেপথ্যে হাত রয়েছে চোরাশিকারিদের। বাকিগুলি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে মারা গিয়েছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রদেশের বালাঘাটের জঙ্গলে রহস্যজনক ভাবে মারা গিয়েছে আরও দু’টি বাঘ। সেখানেও পাচারচক্রের সক্রিয় থাকার ইঙ্গিত পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
গোয়েন্দাদের দাবি, একাধিক রাজ্যে ছড়িয়ে রয়েছে চোরাশিকারিদের জাল। তাঁদের বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করতে ইতিমধ্যেই সক্ষম হয়েছে পুলিশ। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন অজিত রাজগন্ড ওরফে অজিত পারধি, অসম রাইফেলসের সাবেক জওয়ান লালনেইসুং, মায়ানমারের সঙ্গে যুক্ত পাচারকারী নিং সান লুন ও তাঁর স্বামী কাপলিয়ান মুং এবং হাওয়ালা অপারেটর জামখানকাপ। তাঁদের থেকে কোটি টাকার বেশ নগদ উদ্ধার করেন তদন্তকারীরা।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক অসমের এক বনকর্তা বলেছেন, ‘‘এই চক্রটি দেশের একাধিক রাজ্যে বাঘ শিকার করেছে। অন্তত ১০ থেকে ১২টি বাঘের চামড়া, মাংস এবং হাড় পাচারের সঙ্গে এরা জড়িত।’’ আর সেই কারণেই বন আধিকারিকদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে এ দেশের বাঘের সংখ্যা ছিল ১,৪১১। ২০২২ সালে তা বেড়ে ৩,৬৮২তে গিয়ে পৌঁছেছে। ২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরে বাঘ এবং হাতির জন্য ২৯০ কোটি টাকা ধার্য করেছে কেন্দ্র, গত আর্থিক বছরের তুলনায় যা ১৮ শতাংশ বেশি।
বিশ্বের ৭০ শতাংশ বাঘের আবাসস্থল ভারত। দেশে মোট ৫৮টি ব্যাঘ্র সংরক্ষণাগার (টাইগার রিজ়ার্ভ) রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ২০২১ সাল থেকে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে চোরাশিকারিদের দল। দু’বছরের মধ্যে (পড়ুন ২০২৩ সাল) তাদের হাতে প্রাণ গিয়েছে ৩২টি বাঘের। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশে ১৩টি, মহারাষ্ট্রে ৮টি, কর্নাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশে তিনটি করে এবং তামিলনাড়ুতে দু’টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া কেরল, উত্তরাখণ্ড এবং বিহারে একটি করে বাঘ মেরেছে চোরাশিকারির দল।
বাঘ শিকারের কারণ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন মধ্যপ্রদেশের প্রিন্সিপাল চিফ কনজ়ারভেটর অফ ফরেস্ট (ওয়াইল্ড লাইফ) শুভরঞ্জন সেন। তাঁর কথায়, ‘‘দেশের মধ্যে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের তেমন চাহিদা নেই। এর প্রধান বাজার হল চিন। কারণ বাঘের হাড় দিয়ে সেখানে কিছু ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরি হয়। আগে পাচারকারীরা নেপাল ও তিব্বত দিয়ে এগুলি পাচার করত। বর্তমানে মায়ানমারকে রুট হিসাবে বেছে নিয়েছে। ভিয়েতনামেও এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।’’
১৯৭০-এর দশকে ইউরোপ এবং আমেরিকায় বাঘের চামড়ার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় চোরাশিকার বেড়েছিল। ওই সময়ে হংকং এবং চিন হয়ে সেগুলি ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারে চড়া দামে বিক্রি হত। কিন্তু বর্তমানে সেটা পুরোপুরি চিন এবং ভিয়েতনামের দিকে ঘুরে গিয়েছে। এই দুই জায়গাতেই ব্যথা প্রতিরোধ এবং যৌন ক্ষমতাবৃদ্ধির বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরি হয়। এ ছাড়া সেখানে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসাবে ব্যাঘ্র চর্মের বেশ কদর রয়েছে।
২০০৫ সালে ‘জয়নিং দ্য ডট্স’ নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভারত সরকারের টাইগার টাস্ক ফোর্স। সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার শুল্ক দফতরের দেওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে ছ’টন বাঘের হাড় আমদানি করেছে সোল। বিশ্লেষকদের দাবি, ৫০০ থেকে হাজার বাঘের চোরাশিকার ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এই আমদানির অধিকাংশটাই হয় ইন্দোনেশিয়া এবং চিন থেকে। ফলে সেখানে উল্লেখযোগ্য হারে বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় ভারতের দিকে চোরাশিকারিদের নজর পড়েছে।
বিগত দশকগুলিতে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভিয়েতনামে ব্যাপক পরিমাণে চোরশিকার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ ব্যাপারে সে ভাবে ব্যবস্থা নেয়নি সেখানকার সরকার। ফলে বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি একরকম ব্যাঘ্র শূন্য হয়ে পড়েছে। গত বছর এ ব্যাপারে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ব্রিটেনের একটি অসরকারি সংস্থা। তাদের দাবি, বাঘের হাড় সিদ্ধ করে বিশেষ এক ধরনের আঠা তৈরি করা হচ্ছে। এটি ওয়াইনে মিশিয়ে খেতে পছন্দ করেন ভিয়েতনামীরা। ফলে সেখানকার বাজারে এর চাহিদা অনেক।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড এবং ভারতের বন্যপ্রাণী বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর মেরউইন ফার্নান্দেজ় বলেছেন, ‘‘ভিয়েতনামে চাহিদার কারণেই এ দেশে বাঘের চোরাশিকার বৃদ্ধি পেয়েছে, এ কথা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। কারণ, এ ব্যাপারে কোনও প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তবে এটা ঠিক যে ভিয়েতনামে বাঘের হাড়ের চাহিদা বাড়ছে। সে দিকে আমাদের কড়া নজর রাখত হবে।’’
মধ্যপ্রদেশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স এবং স্টেট টাইগার স্ট্রাইক ফোর্সের প্রধান রিতেশ সারোথিয়া জানিয়েছেন, মায়ানমার সীমান্তের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, সেখান থেকে চিন এবং ভিয়েতনামে বাঘের চামড়া ও হাড়ের সর্বাধিক চোরাচালান হচ্ছে। গৃহযুদ্ধের কারণে ইয়াঙ্গনের সরকার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে অপারগ। একেও একটা বড় সমস্যা বলে মনে করেন ভারতের বন দফতরের শীর্ষ আধিকারিকেরা।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, বাঘের চামড়া পাচারের সবচেয়ে পরিচিত রুট হল শিলং-শিলচর-আইজ়ল-চাম্পাই। উত্তর-পূর্বের মাদক চোরাচালানকারীরাও এই রুটটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে মায়ানমারের চিন বিদ্রোহীরা সীমান্তবর্তী খাওমাউই এবং রিহখাওদার নামের দু’টি এলাকা ইয়াঙ্গনের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। এর ফলে তদন্ত চালাতে পদে পদে সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের। ব্যাঘ্র চর্ম বা হাড় পাচারের টাকা হাওলার মাধ্যমে লেনদেন হয় বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
এই পরিস্থিতিতে স্বস্তির খবর একটাই। বিগত কয়েক বছরে বাংলায় বাঘের চোরাশিকারের কোনও ঘটনা ঘটেনি। রাজ্য বন্যপ্রাণ উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য জয়দীপ কুণ্ডু বলেছেন, ‘‘আন্তর্জাতিক সীমান্ত লাগোয়া রাজ্যগুলিতে এই ধরনের অপরাধ সবচেয়ে বেশি ঘটে। আর তাই উত্তর-পূর্বকে বেছে নিচ্ছে পাচারকারীরা। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের রাজ্যের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ফলে রাজ্যের বাঘকে বাঁচাতে হলে এক মুহূর্তের জন্যেও নজরদারিতে ঢিলেমি দিলে হবে না।’’