জলেই নাকি লুকিয়ে আছে জীবন! অথচ সেই জলই এক মহিলার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।
ডুব জলে অবগাহন তো অনেক দূরের কথা, কাক স্নানও এঁর কাছে মৃত্যু যন্ত্রণার শামিল।
দূঃখে চোখে জল এলে তা-ও ফেলতে হয় বুঝে শুনে। কারণ সেই অশ্রু চোখ থেকে গড়িয়ে গালে-গলায় নামলেই পুড়বে ত্বক। জ্বলবে শরীর!
রোজ সকালে ঘুম ভাঙার পর জলের বোতলের দিকে হাত বাড়ান অনেকেই। সাত সকালে গলা শুকোলে ইনিও জল খেতে বাধ্য হন। তবে সেই জল জিভ ছুঁয়ে গলায় নামলে মনে হয় জল নয় বিষপান করছেন।
ইনি অন্য কোনও বিশ্বের মানুষ নয়, তবে এঁর দুনিয়াটা অনেক আলাদা। এঁর নাম রেচেল উইক। রেচেলের জলে অ্যালার্জি।
বাথটবে শরীর ডুবিয়ে আরামের স্নান অনেকের কাছে স্বর্গীয় অনুভূতি হতে পারে। রেচেলের কাছে তা কিন্তু দুঃস্বপ্ন। তাঁর মনে হয় সারা শরীরে তীব্র রাসায়নিক ঘষে দিচ্ছে কেউ।
রেচেলের দুনিয়ায় জল জীবন নয়, বরং মরণ যন্ত্রণার সমান। যে কোনও ধরনের জলের স্পর্শ— তা যদি তার নিজের স্বেদবিন্দুও হয় তবে তা রেচেলকে যন্ত্রণায় কাতর করে ফেলে। লালচে হয়ে ফুলে ওঠে ত্বক। তীব্র জ্বালা, চুলকানির মতো অস্বস্তিও হতে থাকে।
তাঁর সঙ্গে আসে ভয়ানক ক্লান্তি বোধ। রেচেলের কথায়, ‘‘আমার মনে হয় যেন আমি ম্যারাথন দৌড়ে এসেছি। এমন হলে আমাকে কোথাও গিয়ে বিশ্রাম নিতে হয়। বেশ খানিক ক্ষণ পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করি।’’
রেচেলের এই জলে অ্যালার্জির অসুখের একটি নাম আছে— অ্যাকোয়াজেনিক আর্টিসারিয়া।
এর উপসর্গ হল সারা শরীরে বিছুটি পাতা ঘষে দেওয়ার মতো জ্বালা। তার সঙ্গে ঘুসঘুসে জ্বর, নাক দিয়ে জল পড়া, চোখ সরসর করা, হাঁচি, মাথার যন্ত্রণা, বুকে সর্দি বসার মতো ঠান্ডা লাগার উপসর্গ। আর এই সব কিছু রেচেলকে সহ্য করতে হয় প্রতি দিন।
এই পরিস্থিতিতে মনে হতেই পারে জল না খেয়ে, স্নান না করে এই সব উপসর্গ নিয়ে রেচেল বেঁচে আছেন কী করে! যেখানে মানবদেহের ৬০ শতাংশই জল, এক জন প্রমাণ আকৃতির ৭০ কেজি ওজনের প্রাপ্তবয়স্কের শরীরে অন্তত ৪০ লিটার জল থাকে, সেখানে রেচেলের জলে অ্যালার্জি হয় কী করে?
রেচেলের চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, শরীরে সঞ্চিত জল এখানে সমস্যা নয়। সমস্যা হয় তখন, যখন সেই জল ত্বকের সংস্পর্শে আসে বা যখন বাইরে থেকে শরীরে জল প্রবেশ করে। এই জল যদি নিজের শরীর নিসৃত হয়, তাতেও সমস্যা হয়।
রেচেলের চিকিৎসা করতে গিয়ে চিকিৎসকরা দেখেছেন একাধিক বার পরিশোধন করা জলেও কোনও লাভ হচ্ছে না। তাতেও একই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাঁর শরীরে।
রেচেল জানিয়েছেন, সবাই যখন আমার রোগের কথা শোনেন তখন তাঁরা জানতে চান, ‘‘আমি জল পান করি কী ভাবে? স্নান করি কী ভাবে? সবচেয়ে বড় কথা শরীর নোংরা হলে তা সাফ সুতরো রাখি কী ভাবে? আমি ওঁদের বলি— বাধ্য হলে এই সবই আমাকে করতে হয়। আর তখন দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।’’
কিন্তু কেন এই রোগ? যে জল স্বাভাবিক নিয়মে প্রকৃতিই মানবদেহে দিয়েছে, সেই জলকে কোনও শরীর প্রতিরোধ করে কী ভাবে? চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন— অসুখটা একটু অদ্ভুত এবং এর ঠিকঠাক বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি সে ভাবে।
একদল গবেষকের ধারণা, ত্বকের বাইরের অংশ যেখানে মূলত মৃত কোষ এবং তৈলাক্ত পদার্থ থাকে, তা জলের সংস্পর্শে এসে হয়তো কিছু রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে। তা থেকেই জ্বালার অনুভূতি হতে পারে। অন্য একটি মহলের মত, জলের সংস্পর্শে ত্বকের বিভিন্ন স্তরে থাকা জৈব পদার্থ রাসায়নিক তৈরি করে। সেই রাসায়নিক ত্বকের আরও গভীরে প্রবেশ করে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে।
তবে কারণ যা-ই হোক এই অসুখ যে রোগীর জীবনটাই সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে তা মেনে নিয়েছেন চিকিৎসকেরা। এমন অস্বাভাবিক রোগ থেকে হতাশাও আসতে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। রেচেল তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
এই রোগের সে ভাবে কোনও ওষুধ নেই। ওমালিজুমাব নামে যে ড্রাগ দিয়ে চিকিৎসকরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে সুরাহা পেয়েছেন, তার আকাশছোঁওয়া দাম। বিশ্বের কোনও স্বাস্থ্যবিমাও সেই দামের দায় নেয় না। রেচেল তাই সেই ওষুধ কিনতে চেয়েও কিনতে পারেননি।
তার ওপর যে সংস্থা ওই ড্রাগ তৈরি করত তারাও তার উৎপাদন বন্ধ করছে। তাঁদের বক্তব্য কার জন্য তারা এই ওষুধ বানাবে। এই রোগের রোগীও তো হাতে গোনা মাত্র কয়েক জন। প্রতি ২৩ কোটিতে এক জনের এমন অসুস্থতা থাকে। সেই হিসেবে গোটা পৃথিবীতে রেচেলের মতো রোগী থাকতে পারেন মাত্র ৩২ জন।
রোগ থেকে মুক্তি পাবেন না ভেবে হতাশই হয়ে পড়েছিলেন রেচেল। তাঁকে মানসিক জোর জুগিয়েছেন তাঁর স্বামী। যিনি দীর্ঘ দিন রেচেলের দেখাশোনা করেছেন। জলের বদলে এখন দুধ খান রেচেল। তাতে তাঁর যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হয়েছে। কিন্তু সমাধান হয়নি।
কোনও দিন যদি সত্যিই তাঁর রোগের চিকিৎসা সম্ভব হয়, তখন কী করবেন রেচেল? জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর কাছে। রেচেল বলেছেন, ‘‘আমি প্রথমে সমূদ্রে যাব। আর বৃষ্টিতে ভিজব প্রাণ ভরে।’’