Bengal SSC Recruitment Case

ছ’বছরের লড়াই সয়েছে বহু ঘাত-প্রতিঘাত, দেখেছে নানা চমকও! ২০১৮ থেকে ২০২৪— কী কী হয়েছিল?

২০২১ সালের ৫ অগস্ট কলকাতা হাই কোর্টে রুজু করা হয় স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত দু’টি মামলা। একটি গ্রুপ সি নিয়োগ, অন্যটি গ্রুপ ডি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২৬
Share:
০১ ২৫

বিকাশ ভবনের সামনের রাস্তায় ছোটখাটো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ থেকে শুরু। ২০১৮ সালে সেখানে বিক্ষিপ্ত স্লোগান, ধর্না চলত মাঝেমধ্যেই। কিন্তু কেন চলত, জানতেন না অনেকেই।

০২ ২৫

স্কুলে নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তখন সবে বুদবুদের মতো মাথা তুলছে। ঢেউ উঠতে ঢের দেরি। অভিযোগ ছিল ২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় স্কুলের শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু চাকরিপ্রার্থীদের চিৎকার পাত্তা পায়নি বিকাশ ভবনে। তা বলে প্রতিবাদ থেমে থাকেনি।

Advertisement
০৩ ২৫

ক্ষোভ বাড়ছিল। একে একে সংগঠিত হচ্ছিলেন ক্ষুব্ধরাও। শেষে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে প্রথম নিয়োগ দুর্নীতি বিরোধী প্রতিবাদ একটি আপাদমস্তক আন্দোলনের চেহারা নেয়। তখন রাজ্যে এবং গোটা দেশে লোকসভা ভোটের প্রস্তুতি। সেই সময়েই কলকাতায় প্রেস ক্লাবের সামনে দুর্নীতির প্রতিবাদে অনশনে বসলেন চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনকারীরা। ২৯ দিন ধরে চলল সেই অবস্থান!

০৪ ২৫

কিন্তু ভোটের সময় উৎখাতও হতে হল। এর পর একে একে সল্টলেকের করুণাময়ীতে ১৮৭ দিনের ধর্না অবস্থান। সেখান থেকে আন্দোলন উঠে আসে ধর্মতলায় গান্ধীমূর্তির পাদদেশে। তত দিনে কেটে গিয়েছে প্রায় আড়াই বছর। চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন আরও জমি পেয়েছে। সংখ্যা বেড়েছে আন্দোলনকারীদের। নিজেদের অভিযোগ নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁরা।

০৫ ২৫

২০২১ সালের ৫ অগস্ট কলকাতা হাই কোর্টে রুজু করা হয় স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত দু’টি মামলা। একটি গ্রুপ সি নিয়োগ, অন্যটি গ্রুপ ডি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা। ওই একই সময়ে রাজ্যের স্কুলে নবম-দশমের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি নিয়েও মামলা হয় হাই কোর্টে।

০৬ ২৫

প্রায় সমস্ত মামলাই গিয়েছিল তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে। সেখানেই শুরু হয় শুনানি। ২০২১ সালের নভেম্বরে তিনিই প্রথম স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন। দুর্নীতির তল পেতে তদন্তে নামে কেন্দ্রীয় সংস্থা।

০৭ ২৫

এক ধাক্কায় আড়াই বছরের আন্দোলন চলে আসে খবরের শিরোনামে। নতুন করে অক্সিজেন পায় শিক্ষক নিয়োগের সরকারি সংস্থা বিরোধী আন্দোলন।

০৮ ২৫

প্রথম যে মামলাটিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সেটি ছিল এসএসসির গ্রুপ ডি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা। সন্দীপ প্রসাদ নামে এক চাকরিপ্রার্থী করেছিলেন মামলাটি। তার পরে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ মে পর্যন্ত একে একে আরও সাতটি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি।

০৯ ২৫

ওই বাকি সাতটি মামলা করেছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন (গ্রুপ সি), নাসরিন খাতুন (নবম-দশম), সেতাব উদ্দিন (নবম-দশম), লক্ষ্মী তুঙ্গা (গ্রুপ ডি), অনিন্দিতা বেরা (নবম-দশম), আব্দুল গনি আনসারি (নবম-দশম) এবং ববিতা সরকার (একাদশ-দ্বাদশ)। এর মধ্যে শেষ দু’টি মামলা রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির ছবিটাই আমূল বদলে দেয়।

১০ ২৫

এই দু’টি মামলাতেই প্রথম বোঝা যায়, নিয়োগ দুর্নীতির শিকড় অনেক গভীরে! এমনকি, রাজ্যের মন্ত্রীরাও এই দুর্নীতিতে যুক্ত থাকতে পারেন।

১১ ২৫

এর মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় আব্দুল গনি আনসারির কথা। তাঁরই আইনজীবী ফিরদৌস শামিম আদালতের কাছে নথি দিয়ে দাবি করেন, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্নীতির বিষয়ে সবটাই জানতেন রাজ্যের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী তথা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

১২ ২৫

স্কুলে নিয়োগে দুর্নীতির ক্ষেত্রে এসএসসির উপদেষ্টা কমিটির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে— এই মর্মে তত দিনে আদালতের কাছে নানা তথ্য এবং নথি জমা পড়েছে। আনসারির আইনজীবী শামিম বলেন, পরিকল্পিত ভাবে দুর্নীতি করতে পার্থের নির্দেশেই এই উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। হাই কোর্টে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে এই নথি জমা পড়ার পরই তিনি নির্দেশ দেন মন্ত্রী পার্থকে সিবিআইয়ের দফতরে গিয়ে হাজিরা দেওয়ার।

১৩ ২৫

এর ঠিক এক মাস পরে আরও একটি মামলা বাংলার মানুষকে চমকে দেয়। ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল শিলিগুড়ির এক চাকরিপ্রার্থী ববিতা সরকার আদালতে অভিযোগ করেন, যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও এসএসসি তাঁর চাকরি বাতিল করেছে, রাজ্যের এক মন্ত্রী-কন্যাকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য।

১৪ ২৫

ববিতার ওই অভিযোগে হইচই পড়ে যায়। তথ্যপ্রমাণ দিয়ে ববিতা আদালতে দেখান, রাজ্যের মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীর নাম মেধাতালিকায় না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে প্রথম হিসাবে দেখানো হয়েছে। ফলে ওই তালিকার শেষে থাকা ববিতা তালিকা থেকে ছিটকে গিয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন তাঁর প্রাপ্য চাকরি থেকে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এই মামলা শোনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন।

১৫ ২৫

কিন্তু বিচারপতির বেশ কয়েকটি সিবিআই তদন্তের নির্দেশে স্থগিতাদেশও দেয় কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। বিচারপতি হরিশ টন্ডন এবং বিচারপতি রবীন্দ্র সামন্তের বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, সিবিআই নয়, প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি প্রথমে এই অভিযোগের তদন্ত করে দেখবে। তৈরি হয় বাগ কমিটি।

১৬ ২৫

১৩ মে ওই বাগ কমিটি রিপোর্ট পেশ করে হাই কোর্টে। সেই রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয় রাজ্যের স্কুলগুলিতে এসএসসির মাধ্যমে শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় দুর্নীতি হয়েছে।

১৭ ২৫

রিপোর্টে বলা হয়, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ৩৮১ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীকে সুপারিশপত্র দেওয়া হয়েছিল। এঁদের মধ্যে ২২২ জনের নাম কোনও প্যানলে, এমনকি ওয়েটিং লিস্টেও ছিল না। কারণ এঁরা লিখিত পরীক্ষায় পাশই করতে পারেননি। তা সত্ত্বেও এঁদের এসএসসির অফিস থেকে সুপারিশপত্র দেওয়া হয়েছিল।

১৮ ২৫

রিপোর্টে এ-ও বলা হয় যে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অনুমোদনের ভিত্তিতে যে উপদেষ্টা কমিটি তৈরি হয়েছিল, তা বেআইনি। আর ওই কমিটিরই তৎকালীন প্রধান শান্তিপ্রসাদ সিংহ, মধ্য শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় এবং পর্ষদের কর্মী মিলিত ভাবে ভুয়ো সুপারিশপত্র দেওয়ার বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯ ২৫

বাগ কমিটির এই রিপোর্টের ভিত্তিতে আবার শুরু হয় সিবিআই তদন্ত। পরে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে ইডিও যুক্ত হয়। সেই তদন্তেই রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যয়ের বাড়িতে ইডি অভিযান এবং ২০২২ সালের ২৩ জুলাই তাঁর গ্রেফতারি।

২০ ২৫

ইডি পার্থের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের নামে কেনা দু’টি বাড়ি থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার নগদ অর্থ উদ্ধার করে। সেই টাকার পাহাড় থেকে উদ্ধার হয় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের খামও। তত দিনে প্রাথমিকের নিয়োগেও দুর্নীতির কথাও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। এই ঘটনার পর পার্থ এবং অর্পিতা দু’জনকেই গ্রেফতার করে ইডি। গ্রেফতার হন শান্তিপ্রসাদ, কল্যাণময়-সহ এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই।

২১ ২৫

২০১৬ সালের এসএসসি মামলায় মোট ২৪ হাজার পদে নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই নির্দেশ সম্পূর্ণ ভাবে কার্যকর হয়নি। বিচারপতির নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যান চাকরি হারানো ‘শিক্ষক’ এবং শিক্ষাকর্মীরা।

২২ ২৫

সুপ্রিম কোর্ট প্রথমেই চাকরি বাতিলের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয়। পরে এসএসসি সংক্রান্ত সমস্ত মামলা ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর এসএসসির সমস্ত মামলা হাই কোর্টেরই বিশেষ বেঞ্চে ফেরত পাঠায় দেশের শীর্ষ আদালত। সেই সঙ্গে নির্দেশ দেয়, ছ’মাসের মধ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর যাবতীয় মামলার শুনানি শেষ করতে হবে বিশেষ বেঞ্চে।

২৩ ২৫

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো এর পরে এসএসসি সংক্রান্ত সমস্ত মামলার শুনানি হয় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রসিদির ডিভিশন বেঞ্চে। সুপ্রিম কোর্টের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অনুযায়ী আগামী ৯ মের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল এই মামলার শুনানি। তার আগেই ২২ এপ্রিল এসএসসি মামলার রায় ঘোষণা করল আদালত।

২৪ ২৫

সোমবার রায় ঘোষণার দিন ১১৩৫ দিনে পড়ল চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন।

২৫ ২৫

সোমবার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শাব্বার রশিদির বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ এসএসসি মামলা রায়ে সব মিলিয়ে মোট ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল করেছে। অর্থাৎ, ২০১৬ সালে যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের সকলের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্যানেলের মেয়াদ শেষের পরে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, জনগণের টাকা থেকে বেতন নিয়েছেন, তাঁদের চার সপ্তাহের মধ্যে সুদ-সহ বেতন ফেরত দিতে হবে। বছরে ১২ শতাংশ সুদে টাকা ফেরত দিতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement