আজ তিনি এক জন আমলা। মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ার পুরনিগমের প্রথম মহিলা কমিশনার। তবে আমলা হওয়ার পথ যে খুব একটা মসৃণ ছিল তেমনটা নয়।
আজ তাঁকে তাঁর পদের জন্যই সকলে সম্ভ্রম করেন। কিন্তু এই পদ পেতে যে সংগ্রাম, যে লড়াই করতে হয়েছে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে, এক সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে তাঁর জীবনের লড়াইয়ের কাহিনি তুলে ধরেছেন সবিতা প্রধান গৌড়।
আজ তিনি এক জন সফল মা। সফল মেয়ে। কিন্তু এই সাফল্যের নেপথ্যে তাঁর লড়াইটাও কম নয়।
মধ্যপ্রদেশের মণ্ডী জেলার এক আদিবাসী পরিবারে জন্ম সবিতার। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব নড়বড়ে ছিল। ছোটবেলা থেকেই সবিতার পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক ছিল। তাই শত বাধা পেরিয়েও বাড়ি থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে একটি স্কুলে পড়তে যেতেন সবিতা।
গ্রামের মধ্যে প্রথম মেয়ে হিসাবে দশম শ্রেণির পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন সবিতা। ভাল পড়াশোনার জন্য স্কুল থেকে বৃত্তিও পেয়েছিলেন। সেই বৃত্তির টাকাতেই পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দশম পাশ করে সাত কিলোমিটার দূরের একটি স্কুলে পড়তে যেতেন। বাসে যাওয়ার মতো ২ টাকা ভাড়াও ছিল না তাঁর কাছে। তাই প্রতি দিন হেঁটে এই পথ যাতায়াত করতে হত সবিতাকে।
স্কুলে পড়াশোনা করতে করতেই বিয়ের সম্বন্ধ আসে। আর্থিক টানাপড়েনের জেরে কম বয়সেই সবিতাকে বিয়ে দিয়ে দেন তাঁর বাবা-মা।
এখান থেকে শুরু অন্য লড়াই। সবিতার দাবি, বিয়ের কয়েক দিন পর থেকেই স্বামীর অত্যাচার শুরু হয়। তাঁকে প্রায়ই মারধর করতেন স্বামী।
এই কাজে মদত জোগাতেন তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি। তাঁর কথায়, “আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। কিন্তু তাতেও কোনও রেহাই মেলেনি। খাবার জুটত না ঠিক করে। লুকিয়ে লুকিয়ে শুকনো রুটি খেতে হত।”
সবিতা আরও জানান, মুখ বুজে সব রকম অত্যাচার সহ্য করতে হত। তাঁর কথায়, “অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমাকে দিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করানো হত। শ্বশুরকে তেল মালিশ করতে হত। সব কিছু করার পরেও ওদের মন ভরত না।”
সবিতা দুই সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু তার পরেও শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার থামেনি। সবিতা বলেন, “এত অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করি। আমি যখন ঘরে আত্মহত্যার চেষ্টা করছিলাম, আমার শাশুড়ি সেই ঘটনা দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। বাধা দিতে আসেননি। তখন ভাবলাম, আমি মরে গেলে ওদের কিছু ক্ষতি হবে না। বরং আমার সন্তানদের ক্ষতি হবে। তার পরই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসি।”
সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন সবিতা। সন্তানদের মানুষ করার জন্য বিউটি পার্লারে কাজ নেন।
আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন। ইনদওর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনপ্রশাসনে (পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) স্নাতকোত্তর করেন। এর পর তিনি ইউপিএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেন।
২০১৭ সালে প্রথম প্রচেষ্টাতেই ইউপিএসসি পরীক্ষায় পাশ করেন। সবিতা বলেন, “হেরে যাওয়ার মানসিকতা ছিল না আমার। ছোটবেলা থেকে যে লড়াই দেখেছি, সহজে হার মানার পাত্রী ছিলাম না। তাই আজ আমি সফল।”
২০২১ সালে খান্ডোয়া পুরনিগমের প্রথম মহিলা কমিশনার হিসাবে নিযুক্ত হন সবিতা। সেখানে পোস্টিং হতেই মাফিয়াদের কড়া হাতে দমন করে খবরের শিরোনামে আসেন।
নিজের কাজের জন্য সব সময় আলোচনার মধ্যে থাকেন এই মহিলা কমিশনার। কয়েক বছর আগে নিজের চার মাসের সন্তানকে নিয়ে অফিসের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। যা দেখেও সকলে স্তম্ভিত হয়েছিলেন। মন্দসৌরেও মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করে জনসাধারণের মন জিতে নিয়েছিলেন।
যে কোনও সাফল্যের নেপথ্যে যে লড়াই থাকে, যে শ্রম থাকে, তা অনেকেই দেখতে পান না। অনেক সময়ই তা অকথিত থেকে যায়। সেই সব গল্প প্রকাশ্যে এলে অনেকে অনুপ্রেরণা পেতে পারেন। সবিতার লড়াইও তেমন।