একই মহল্লায় অসংখ্য সমনামী থাকতেই পারেন। তাঁদের সকলের নামে চিঠি এলে কোন জাদুবলে তা সঠিক জনের কাছে পৌঁছয়? চিঠির গায়ে লেখা ঠিকানার পিন কোডেই রয়েছে সে চাবিকাঠি। ইন্টারনেটের যুগে চিঠিচাপাটির গুরুত্ব কমলেও পিন কোড আজও স্বমহিমায় বিদ্যমান।
৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের দিনে নিজের জন্মদিন পালন করছে ছ’নম্বরের দেশীয় পিন কোডও। ১৯৭২ সালের এই দিনেই এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল।
আমজনতার কাছে পিন কোড শুধুমাত্রই কয়েকটি সংখ্যা। তবে এই নম্বরের ‘রহস্যভেদ’ করেই চিঠিপত্র, পার্সেল পৌঁছে দেন ডাককর্মীরা। আবার এটির মাধ্যমেই অনলাইনে অর্ডার করা জিনিসপত্রও সঠিক ঠিকানায় চলে আসে।
এ দেশে পিন কোডের ছয়টি নম্বরের মধ্যে কী কী ‘রহস্য’ লুকিয়ে রয়েছে? কী ভাবেই তা নির্ধারিত হয়? হঠাৎ করে এর প্রয়োজন হল কেন? পিন কোডের ইতিহাসই বা কী?
পোস্টাল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার বা পিআইএন— এই নামের মধ্যেই এর ব্যবহারিক উদ্দেশ্য নিহিত। ডাকঘরে জমা পড়া হাজারো চিঠিচাপাটি বা পার্সেলের পাহাড় ঝাড়াই-বাছাই করে সঠিক ব্যক্তির হাতে তাঁর চিঠি, পার্সেল পৌঁছে দেওয়াই ডাককর্মীদের কাজ। তবে একই নামের অনেক ব্যক্তি থাকলে সঠিক লোকের হাতে তা পৌঁছবে কী ভাবে? সেই কাজটিই করে পিন কোড।
ডাকবিভাগ জানিয়েছে, স্বাধীনতার সময় কালে গোটা দেশে ২৩,৩৪৪টি ডাকঘর ছিল। এবং মূলত তা ছড়িয়ে ছিল শহরাঞ্চলে। তবে তা আড়েবহরে বেড়েছে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, দেশ জুড়ে ১৫৪,৯৬৫টি ডাকঘর রয়েছে। এ ছাড়া, গোটা দেশকে ২৩টি পোস্টাল সার্কলে ভাগ করা হয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সঠিক ব্যক্তির হাতে তাঁর চিঠি বা পার্সেল পৌঁছে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেই সময়ই পিন কোডের জন্ম হয়।
কী ভাবে কাজ করে এটি? ডাকবিভাগ জানিয়েছে, পিন কোডের ছ’টি নম্বরের প্রত্যেকটির আলাদা অর্থ রয়েছে।
এ দেশে পরিষেবার নিরিখে ডাকবিভাগের কয়েকটি অঞ্চল রয়েছে। উত্তরাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল, দক্ষিণা়ঞ্চল এবং সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষ অঞ্চল, যাকে '৯ নম্বর'ও বলা হয়।
পিন কোডের প্রথম সংখ্যাটির মাধ্যমে বোঝা যায়, চিঠি বা পার্সেল ডাকঘরের কোন অঞ্চলের জন্য এসেছে অথবা তা কোন রাজ্যে পাঠাতে হবে।
পিন কো়ডের দ্বিতীয় সংখ্যাটি অঞ্চলের আওতায় থাকা এলাকা বা সাব-জোনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। তৃতীয় সংখ্যাটি থেকে জানা যায়, ওই সাব-জোনের মধ্যে থাকা বাছাই করা জেলা। পিন কোডের শেষের তিনটি সংখ্যা থেকে ডাকঘরের নাম জানা যায়।
বাছাই করা জেলাটি মূলত ডাকবিভাগীয় অঞ্চলের অন্তর্গত বৃহত্তম শহরের প্রধান ডাকঘরের সদর দফতর। একে 'বাছাই অফিস' বলা হয়।
আপাতদৃষ্টিতে পিন কোডের বিষয়টি জটিল মনে হলেও ডাককর্মীদের দক্ষতায় গোটা প্রক্রিয়াটি বেশ সহজ-সরল হয়ে উঠেছে। তবে তা সত্ত্বেও ভুল ঠিকানায় যে অন্যের চিঠি বা পার্সেল পৌঁছয় না, এমন নয়।
এ দেশে পিন কোডের বাস্তবায়নে মরাঠি কবি শ্রীরাম ভিকাজি বেলণকরের কৃতিত্ব প্রাপ্য। সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি তিনি যোগাযোগ মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করতেন। সেই সঙ্গে ডাক এবং তার বিভাগের বোর্ডের সদস্যও ছিলেন।
বস্তুত, 'পিন কোডের জনক' হিসাবে পরিচিত শ্রীরাম সংস্কৃত ভাষায়ও বেশ চমকপ্রদ কাজ করেছেন। তাঁর লেখা কবিতা এবং সংস্কৃত নাটকের বইয়ের সংখ্যা ১০৫।
সংস্কৃত নাটক 'বিলোমা কাব্য'-এর রচয়িতা হিসাবেও সাহিত্যজগতে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন শ্রীরাম। 'বিলোমা কাব্য' গোড়া থেকে পড়লে দেখা যায়, ওই নাটকের ছত্রে ছত্রে রয়েছে রামচন্দ্রের স্তুতি। তবে শেষ দিক থেকে পড়লে ছত্রগুলির অর্থ বদলে গিয়ে কৃষ্ণের গুণগাথার রূপ নেয়।
পিন কোডের বাস্তবায়ন করে দেশের ডাক ব্যবস্থায় কার্যত আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন শ্রীরাম। তবে সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। মুম্বইয়ে একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীও গড়়ে তুলেছিলেন। ‘দেববাণী মন্দিরম’ নামের এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল দেশবিদেশে সংস্কৃত ভাষার প্রচার ও প্রসার।
'ইন্ডিপ্লেক্স' নামে ডাকটিকিট সংগ্রহকারীদের বিশ্বজোড়া একটি গোষ্ঠীর চেয়ারম্যানও ছিলেন শ্রীরাম। ১৯৭৩ সালে ১২০টি দেশকে নিয়ে একটি সম্মেলনের পিছনেও তাঁর বড়সড় ভূমিকা ছিল। সে বছরের শেষ দিনে দীর্ঘ কর্মজীবন থেকে অবসর নেন শ্রীরাম। মৃত্যুর তিন বছর আগে ১৯৯৬ সালের তাঁকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
এ দেশে পিন কোড হিসাবে পরিচিত হলেও আমেরিকায় তা 'জিপ' (জোন ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান) কোড নামে পরিচিত। ১৯৬৩ সালের ১ জুলাই সে দেশে ডাকবিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় তা শুরু করা হয়েছিল। মূলত চিঠিপত্র দ্রুত পৌঁছে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য।
আমেরিকায় জিপ কোড চালু হওয়ার আগে ডাকঘরগুলিতে ১৭টি পর্বে চিঠিচাপাটি বাছাই করা হত। তবে জিপ কোড আসার পর নতুন পদ্ধতিতে সময় বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল।
আমেরিকার মতো ব্রিটেনেও ষাটের দশকের মাঝামাঝি মেশিনের মাধ্যমে চিঠিপত্র বাছাই করার পদ্ধতি চালু হয়েছিল। কোডিং যন্ত্রের মাধ্যমে পোস্টাল কোডকে বিভিন্ন ধাঁচের বিন্দুতে ভেঙে দেওয়া যেত। এর পর চলত ওই ধাঁচ অনুযায়ী চিঠিপত্র বাছাই পর্ব। কায়িক শ্রমের বদলে যন্ত্রের মাধ্যমে চিঠিপত্র বাছাই চালুর পর ডাকঘরের কাজে আট গুণ দ্রুত গতি এসেছিল।
আমেরিকা বা ব্রিটেনের মতো জাপানেও যন্ত্রের মাধ্যমে চিঠিপত্র বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়েছিল। সেটি ছিল ষাটের দশকের শেষ ভাগ। ১৯৬৮ সালে জাপানের প্রতিটি ডাকঘরে স্বয়ংক্রিয় পোস্টাল কোড রিডার চালু করা হয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে বৈদ্যুতিন যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে চিঠিচাপাটির সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবেও উঠে এসেছে চিঠির বিকল্প। তবে কি পিন কোড ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত? এর উত্তরে বলতে হয়, চিঠিচাপাটির চালাচালি কমেছে বটে। তবে অনলাইনে কেনা জিনিসপত্র হাতে পেতে হলে আজও পিন কোডের প্রয়োজন হয়ে পড়ে!