১৯৬৪ সালে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আইডিবিআই ব্যাঙ্কের জন্ম হয়েছিল শিল্পখাতে আর্থিক পরিষেবা দেওয়ার জন্য। ৬১ বছর আগে শিল্পোন্নয়ন ব্যাঙ্ক হিসাবে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠানটি এখন স্বীকৃত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক হিসাবে। শিল্পোন্নয়নের জন্য তৈরি আর্থিক সংস্থাটি সরকারি নির্দেশে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে রূপান্তরিত হয় ২০০৪ সালে।
সূত্রের খবর, এই ব্যাঙ্কটির সংযুক্তিকরণ নিয়েই বড়সড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে কেন্দ্র। আইডিবিআই ব্যাঙ্কের সিংহভাগ অংশ অন্য কোনও ব্যাঙ্কিং সংস্থা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিক্রি করে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে অর্থ মন্ত্রক। সরকারি মালিকানা থাকলেও ব্যাঙ্কটি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তালিকাভুক্ত বেসরকারি ব্যাঙ্কের তকমাপ্রাপ্ত।
৩১ অক্টোবর দরপত্র প্রক্রিয়া চূড়ান্ত ও অনুমোদনের জন্য বৈঠকে বসার কথা ছিল। বিনিয়োগ ও পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং আর্থিক পরিষেবা বিভাগের সচিবদের নিয়ে বৈঠকে স্থির হওয়ার কথা ছিল আইডিবিআই ব্যাঙ্কের ভবিষ্যৎ। সে সংক্রান্ত চূড়ান্ত কোনও খবর পাওয়া যায়নি এখনও পর্যন্ত।
বর্তমানে আইডিবিআই ব্যাঙ্কের ৪৫.৪৮ শতাংশের মালিকানা রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এ ছাড়াও ৪৯.২৪ শতাংশের মালিক ভারতীয় জীবনবিমা নিগম (এলআইসি)। কেন্দ্র এবং এলআইসির ৬০.৭ শতাংশ মালিকানা বিক্রি করতে আগ্রহী।
বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে ব্যাঙ্কটিকে আর্থিক ভাবে আরও সক্ষম করে তুলতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। শিল্পোন্নয়ন ব্যাঙ্ক হিসাবে আইডিবিআই ছিল শিল্প ঋণের অন্যতম সূত্র। ঋণ তহবিলও ছিল মোটা। ঋণখেলাপের সমস্যা নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে খাবি খাচ্ছিল এই ব্যাঙ্কটি।
২০২১ সাল থেকেই ব্যাঙ্কের বিলগ্নিকরণের জন্য সওয়াল করছিল কেন্দ্র। সরকারের হাতে থাকা ব্যাঙ্কে ৩০.৪৮ শতাংশ মালিকানা (বর্তমান মূল্য প্রায় ২১,৬৯০ কোটি টাকা) এবং এলআইসির থেকে ৩০.২৪ শতাংশ শেয়ার বিলগ্নিকরণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। আইডিবিআই ব্যাঙ্কের শেয়ার কেনার জন্য কোটাক মহিন্দ্রা ব্যাঙ্ক, সিএসবি ব্যাঙ্ক এবং এমিরেট্স এনবিডি ব্যাঙ্ক আগেই আবেদন জানিয়েছে।
অল ইন্ডিয়া আইডিবিআই অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (এআইআইওএ) কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের কাছে ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। আমানতকারী, ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা এবং কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আইডিবিআইকে যে কোনও সরকারি ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযুক্তিকরণের কথা বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি।
অনুৎপাদক সম্পদের ভারে ধুঁকতে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে ওই সমস্যা থেকে বার করে ঘুরিয়ে দাঁড় করতে ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠানগুলির সংযুক্তিকরণ এবং বেসরকারিকরণের পথে হাঁটছে কেন্দ্র। ২০৪৭ সালের মধ্যে ব্যাঙ্কের শক্তিবৃদ্ধির পক্ষে সওয়াল করে সরকার। তাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তারা।
২০১৯ সালে ব্যাঙ্কের পুঁজি বৃদ্ধি করতে সরকার কমপক্ষে ১০টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে একত্রিত করে চারটি বৃহৎ ব্যাঙ্ক তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুযায়ী ২০২০ সালে, পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের (পিএনবি) সঙ্গে ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্স (ওবিসি) এবং ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (ইউবিআই) সংযুক্ত হয়ে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাঙ্ক তৈরি হয়।
২০১৭ সালে ভারতে ২৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অস্তিত্ব ছিল। সংযুক্তিকরণের পর দেশে মোট সাতটি বড় ও পাঁচটি ছোট রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক রয়েছে। বছর পাঁচেক আগে প্রথম ধাপের সংযুক্তিকরণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় ধাপের সংযুক্তিকরণের পথে হাঁটতে চায় কেন্দ্র।
সংযুক্তিকরণের প্রধান উদ্দেশ্যই হল পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ও পুঁজিবৃদ্ধি। অনুৎপাদক সম্পদের ভার লাঘব করা। কেন্দ্রের বক্তব্য, বিভিন্ন ক্ষেত্র ও পরিষেবা যে ব্যাঙ্কের সেরা, সংযুক্তিকরণের পরে সেই ব্যাঙ্কের সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি গ্রহণ করা হবে। তাতে নতুন ব্যাঙ্কটি শুধু পুঁজি নয়, পরিষেবার দিক থেকেও শক্তিশালী হবে।
২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষের মধ্যে ভারতকে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল কেন্দ্র। ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ সেই প্রক্রিয়ায় গতি আনবে বলেও দাবি করেছেন তিনি। সংযুক্তিকরণের পরে নতুন ব্যাঙ্কগুলির পরিষেবার ক্ষেত্র বাড়বে, উন্নত হবে প্রযুক্তি এবং ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা।
ব্যাঙ্ক দুর্বল হয়ে পড়লে তার প্রতি আস্থা ফেরাতে সরকারকে মূলধন জোগাতে হয়। কোভিড অতিমারির পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য চাঙ্গা রাখতে ৩.১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। সংযুক্তিকরণের পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা ২৭ থেকে ১২-তে নেমে এসেছে। ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে। আগের থেকে তারা অনেক বেশি স্থিতিশীল, জানিয়েছে আরবিআই।
পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের (পিএনবি) সঙ্গে ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্স (ওবিসি) এবং ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (ইউবিআই) সংযুক্ত হওয়ার পর ২০২১-’২২ সালের অর্থবর্ষে ব্যাঙ্কের সম্পদের পরিমাণ ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৭.৯ লক্ষ কোটি টাকায়। কানাড়া ব্যাঙ্কের মূলধন বেড়েছে ১০.৭ লক্ষ কোটি টাকা। সংযুক্তিকরণের দু’বছরের মধ্যেই পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ১৫৫৫ কোটি টাকা লাভের মুখ দেখেছিল।
ব্যাঙ্কগুলি সংযুক্ত হওয়ায় কমেছে পরিচালন খরচ। কিছুটা কমেছে অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণও। ২০১৮-’১৯ আর্থিক বছরে অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ ছিল ১১ শতাংশেরও বেশি। ২১-২২ সালের আর্থিক বছরে তা তিন শতাংশ কমে গিয়ে ৯ শতাংশের কিছু বেশি ছিল। কমেছে পরিচালনা ব্যয়ও।
যে কোনও সংস্থায় সংযুক্তিকরণ বা বেসরকারিকরণ হলেই কর্মীছাঁটাইয়ের শঙ্কা প্রবল হয়। বেতন, পেনশনের মতো বিষয়গুলি নিয়ে অনিশ্চয়তা শুরু হয়ে যায়। এর আগে প্রথম ধাপে ব্যাঙ্কগুলির সংযুক্তিকরণের সময় নির্মলার আশ্বাস ছিল ব্যাঙ্ককর্মীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনও পদক্ষেপ কেন্দ্র করবে না। সব দিক পর্যালোচনা করেই বেসরকারিকরণ সংক্রান্ত পদক্ষেপ করা হবে।
যদি কোনও ব্যাঙ্ক আইডিবিআইকে অধিগ্রহণের দরপত্রে জয়ী হয় তাহলে দু’টি সংস্থাকে সংযুক্তিকরণের জন্য বেশ কিছুটা সময় দেবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। কোনও সংস্থা একটি ব্যাঙ্ক চালানোর যোগ্য কি না, সেই বিষয়ে সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে এক থেকে দেড় বছর সময় নেয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। তবে ১৩ হাজার কর্মী নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিমধ্যেই দোলাচলে ভুগতে শুরু করেছেন।
আইডিবিআই ব্যাঙ্ক ২০২১ সালের মার্চ মাসে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রম্পট কারেকশন অ্যাকশন কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসে। কোনও ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট আর্থিক সূচক (যেমন মূলধন অনুপাত, সম্পদের গুণমান, নিট লাভ) যখন নির্ধারিত সীমার নীচে চলে যায়, তখন ব্যাঙ্কটির ওপর নজরদারি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কটি।
পাঁচ বছরের ব্যবধানের পর ব্যাঙ্কটি মুনাফার অঙ্কে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে ১ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকার নিট মুনাফা করে আইডিবিআই। ২০২২-’২৩ সালে তা বৃদ্ধি পায় ২ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকায়। ধারাবাহিক ভাবে লাভ করে ব্যাঙ্কটি। ২০২৪ সালের অর্থবর্ষে ৩ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। গত অর্থবর্ষে ৫ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা নিট লাভ করেছে ব্যাঙ্কটি।
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৪০ সালের মধ্যে ভারতের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৪.৫ লক্ষ কোটি ডলারের প্রয়োজন পড়বে। স্বাধীনতার ১০০ বছরে গিয়ে ‘বিকশিত ভারতের’ স্বপ্ন পূরণ করতে দেশে বৃহৎ দু’টি ব্যাঙ্কের প্রয়োজন পড়বে বলে মনে করছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, নিয়ন্ত্রক, ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞ-সহ নানা পক্ষের প্রতিনিধিরা।
আন্তর্জাতিক লড়াইয়ের ময়দানে নামতে গেলে ভারতকে ধাপে ধাপে দ্বিতীয় পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিতে হবে বলে মনে করছেন আর্থিক বিশেষজ্ঞেরা। আগামী পাঁচ বছরে প্রধান দু’টি ব্যাঙ্ককে বাছাই করতে হবে কেন্দ্রকে। তাদের পুঁজিবৃদ্ধি এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে সংস্কার আনা জরুরি। অভ্যন্তরীণ পরিষেবার বদলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিষেবা প্রদানে গুরুত্ব দিতে হবে ব্যাঙ্কগুলিকে।