তিনি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারেও আছেন, আবার ঝাঁটা হাতে মাঠেঘাটেও আছেন। কখনও তেজস বিমানে আকাশে মহড়া দিচ্ছেন, তো কখনও ডুব দিচ্ছেন সমুদ্রতলে! গত দেড় থেকে দু’বছর মোদীর গতিবিধিতে নজর দিলে দেখা যাবে, তিনি রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে সর্বত্র বিদ্যমান। শুধু তা-ই নয়, ‘রোমে গেলে রোমান সাজা’র নীতিকে মাথায় রেখে মোদীর বেশভূষাও বদলেছে প্রতিটি সফরে। লোকসভা নির্বাচনের আগে তাই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পোশাকনামায় চোখ রাখল আনন্দবাজার অনলাইন।
মাস চারেক আগেই তেজসে উঠে একটা ছোটখাটো মহড়া বা ‘সর্টি’ নিয়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী। তেজস বায়ুসেনাবাহিনীর যুদ্ধবিমান, যা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুঘাঁটি ধ্বংস করার পাশাপাশি উদ্ধারকাজেও ব্যবহার হয়। মোদী যুদ্ধক্ষেত্রে না গেলেও পুরোদস্তুর বায়ুসেনার পোশাকেই সেজেছিলেন। বসেছিলেন তেজসের কো-পাইলটের আসনে। পরে বিমান থেকে নেমে কালো রোদচশমা পরে কোমরের কাছে হেলমেটটিকে ধরে যখন এগিয়ে আসছিলেন, তখন সেই দৃশ্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন গ্ল্যামার জগতের বহু তারকাও। অনেকে দৃশ্যটিকে টম ক্রুজ অভিনীত হলিউডের ছবি ‘টপ গান: মাভেরিক’-এর সঙ্গেও তুলনা করেছিলেন।
এমন ‘রণসজ্জা’য় অবশ্য আগেও দেখা গিয়েছে মোদীকে। প্রতি বছরই দীপাবলি পালন করতে সীমান্তের বিভিন্ন সেনাঘাঁটিতে যান মোদী। ২০২৩ সালে গিয়েছিলেন হিমাচলপ্রদেশের লেপচায়। সেখানে সেনাবাহিনীর বালুরঙা জংলা পোশাকে দেখা গিয়েছিল মোদীকে।
২০২২ সালে গিয়েছিলেন কার্গিলে। ২০২১ সালে নওশেরায়।
২০২০ সালে কোভিডের বছরে গিয়েছিলেন রাজস্থান এবং ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দীপাবলিতে গিয়েছিলেন জম্মু এবং কাশ্মীরের রাজৌরিতে।
এ তো গেল রণসজ্জার কথা। মোদীর বনসজ্জা নিয়েও কম আলোচনা হয়নি। ২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মোদীর জন্মদিনে মধ্যপ্রদেশের কুনো অভয়ারণ্যে আটটি চিতাবাঘ ছাড়া হয়েছিল। সেই চিতাদের দেখতে জন্মদিনে কুনোয় এসেছিলেন মোদী। হালকা আকাশি কুর্তার উপরে সাফারি জ্যাকেট পরেছিলেন মোদী। মাথায় ছিল কেতাদুরস্ত ফেডোরা হ্যাট। মোদীকে এমন পোশাকে দেখে চমকে গিয়েছিলেন দেশবাসী। তবে চমকের তখনও বাকি ছিল।
২০২৩ সালের এপ্রিলে মোদী আবার জঙ্গল সফরে বার হন। এ বার যান কর্নাটকের বান্দিপোরা অভয়ারণ্যে। তবে জঙ্গলে আর কুর্তা-পাজামা পরেননি। বদলে মোদী বেছে নিয়েছিলেন খাকি ফুল প্যান্ট, টিশার্ট আর খাকি রঙের জ্যাকেট। চোখে বাদামি কাচের সানগ্লাস। মাথায় সেই কেতাদার ফেডোরা হ্যাট। পায়ে কালো বুট। হাতে দূরবিন আর ডিএসএলআর ক্যামেরা নিয়ে মোদীর ছবি দেখে ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার বলে ভুল করেছিলেন অনেকে।
২০২৪ সালে মোদী গিয়েছিলেন অসমের কাজিরাঙায়। মোদী ভক্তেরা বলেছেন, এখানে আরও কেতা বেড়েছে মোদীর। সেনাবাহিনীর জংলা ছাপের কার্গো প্যান্টের সঙ্গে একই ছাপের টিশার্ট পরেছিলেন মোদী। তার উপরে পরেছিলেন কালো রঙের কার্গো জ্যাকেট। উলের মাফলারটিকে নিয়েছিলেন দেবানন্দের স্টাইলে। পায়ে বালু রঙের লোফার্স। তার সঙ্গে মাথায় গাঢ় রঙের কাউবয় হ্যাট। চোখে সানগ্লাস। চলন্ত জিপের রডে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলেন মোদী। ফ্রেম থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিল আত্মবিশ্বাস। হয়তো কিছুটা নিষ্পাপ অহংবোধও প্রতিফলিত হচ্ছিল।
জলেও সমান স্বচ্ছন্দ মোদী। সম্প্রতি জলে নিমজ্জিত ভগবান কৃষ্ণের জন্মভিটে দ্বারকার দর্শনে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আরবসাগরের নীচে মোদী নেমেছিলেন গেরুয়া পাঞ্জাবি, গেরুয়া পাজামার উপর গেরুয়া রঙের মোদী জ্যাকেট পরে। কোমরে একটি সিল্কের বন্ধনী বেঁধেছিলেন তিনি। তাতে গোঁজা ছিল ময়ূরের পালক। ওই পোশাকে আরবসাগরের নীচে বসে ধ্যান করতেও দেখা যায় মোদীকে। ডুবুরিদের পোশাক না পরলেও মাথায় ডুবুরিদের হেলমেট, সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল তাঁর।
লক্ষদ্বীপেও জলের নীচে নেমেছিলেন মোদী। সেখানে তাঁকে দেখা গিয়েছিল কালো পোশাকে। সঙ্গে ছিল ডুবুরিদের কমলা রঙের জ্যাকেট।
তবে লক্ষদ্বীপ নজর কেড়েছিল মোদীর অন্য পোশাকের কারণে। মোদীর লক্ষদ্বীপ সফরকালে প্রায় প্রতি দিনই নীল জল আর সাদা বালির সৈকতে নানা রকম কারুকাজের শাল, আর পাঞ্জাবি-পাজামা পরে প্রাতঃভ্রমণে বেরোতেন। সেই ছবি এক রকম ভাইরাল হয়ে যায় ইন্টারনেটে।
প্রধানমন্ত্রীর দক্ষিণ ভারত সফরেও তাঁর পোশাক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দক্ষিণ ভারত সফরে দক্ষিণ ভারতের নানা তীর্থক্ষেত্র দর্শনে গিয়েছিলেন মোদী। আর তার জন্য পরেছিলেন দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শার্টের সঙ্গে ধুতি এবং চাদর।
কখনও উজ্জ্বল গেরুয়া রঙের দক্ষিণ ভারতীয় গাদোয়ালের ধুতি-চাদরে, কখনও বা দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত সোনালি পাড়ের কাসাভুতে দেখা গিয়েছে মোদীকে।
দিন কয়েক আগে খাস দিল্লিতেও দক্ষিণ ভারতীয় পোশাকে দেখা গিয়েছিল মোদীকে। সাদা ধুতির সঙ্গে গলাবন্ধ কোট এবং কাশ্মীরি কারুকাজের উলের শাল গায়ে দিয়েছিলেন মোদী। দক্ষিণ ভারতীয় অনুষ্ঠান পোঙ্গল উপলক্ষে আয়োজিত পুজোয় ওই পোশাকে হাজির হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
মন্দির দর্শনে মোদীর পোশাক তার পরেও নজর কেড়েছে। অযোধ্যার রামমন্দির উদ্বোধন করতে এসেছিলেন মোদী। সেখানে তিনি পরেছিলেন সোনালি আভার ক্রিমরঙা সিল্কের পাঞ্জাবি, একই রঙের জ্যাকেট এবং সাদার উপর সোনালি পাড় দেওয়া দক্ষিণ ভারতীয় ধুতি। গলাতেও ওই একই কাপড়ের সোনালি পাড়ের সাদা উড়নি ঝুলিয়েছিলেন মোদী।
সন্ধ্যায় ওই পোশাকের উপরেই জড়িয়ে নিয়েছিলেন কাশ্মীরের পশমিনা শাল।
ফেব্রুয়ারিতে আবু ধাবির হিন্দু মন্দির উদ্বোধনে প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন মোদী। পোশাক সচেতন মোদী সেখানে পরে গিয়েছিলেন খাঁটি রেশমের পিচ রঙের ধুতি পাঞ্জাবি, জ্যাকেট এবং উড়নি। বৈভবের দুনিয়ায় ভারতীয় সমৃদ্ধির বিচ্ছুরণ ধরা পড়েছিল সেই বেশভূষায়।
মন্দির এবং মোদীর পোশাক নিয়ে আলোচনা করতে বসলে উত্তরাখণ্ডের কথাও বলতে হয়। উত্তরাখণ্ডের ঐতিহ্যবাহী ‘রাঙ্গা’ পরে মাথায় পাগড়ি বেঁধে আদি কৈলাসের সামনে পার্বতী কুণ্ডে বসে প্রার্থনা করেছিলেন মোদী। আবার হিমাচলে ভোটের সময় কেদার-বদ্রীতে পুজো দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী পরেছিলেন হিমাচলি পোশাক চোলা ডোরা।
সম্প্রতি কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে গিয়ে মালার আবরণেও মাথা ঢেকেছিল মোদীর। নিজের কেন্দ্র বারাণসীতে লোকসভা ভোটের প্রচারে গিয়েছিলেন মোদী। মন্দিরে পুজো দিতে ঢুকেছিলেন ঘিয়ে রঙের কুর্তার উপর সাদা-সোনালি ছাপে উড়নি গলায় দিয়ে। ভিতরে তাঁকে মালার আবরণে সাজিয়ে দেওয়া হয়।
এ তো গেল মন্দির সফরের পর্ব। মোদীর পোশাকের রূপ বদলেছে বিদেশভ্রমণেও। বিদেশে গেলে এক সময় সাফারি স্যুট পরতেন মোদী। যদিও সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডাকে মোদী হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন তাঁর চিরচেনা কুর্তা চুড়িদার আর জ্যাকেট পরেই। আবার মঙ্গোলিয়ায় গিয়ে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে দেখা গিয়েছে মোদীকে। কাজাখস্তানে গিয়ে পরেছেন তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে।
গত বছর দিল্লিতে আফগানিস্তানের হিন্দু শিখেরা সিএএ-র জন্য ধন্যবাদ জানাতে এসেছিলেন মোদীকে। সঙ্গে এনেছিলেন আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী জোব্বা এবং মাথার পাগড়ি। মোদী সেই পোশাক পরেই তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভোট ছিল মেঘালয়ে। তার আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে মোদী শিলংয়ে এসেছিলেন কিছু প্রকল্পের উদ্বোধনে। সেই সফরে ওই অনুষ্ঠানের জন্য মোদী বেছে নিয়েছিলেন মেঘালয়ের খাসি সম্প্রদায়ের পোশাক এবং গারো সম্প্রদায়ের শিরস্ত্রাণ। মেঘালয়ের মূল দু’টি সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই মোদী ওই পোশাক বেছে নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিল বিজেপি সূত্র। নিন্দকেরা অবশ্য বলেছিলেন, এ সবই ভোটের চমক।
সেই ভাবনায় যদিও ইন্ধন জুগিয়েছেন মোদী নিজেই। ১৫ অগস্ট এবং ২৬ জানুয়ারির অনুষ্ঠানে বহু বার তাঁকে দেখা গিয়েছে আসন্ন বিধানসভা ভোটের রাজ্যের ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে শিরসজ্জা করতে। কখনও তাঁর পাগড়িতে স্থান পেয়েছে রাজস্থানের বাঁধনি প্রিন্ট, আবার কখনও মাথায় পরেছেন হিমাচলি টুপি।
বিভিন্ন রাজ্যে ভোটের প্রচারে গিয়ে সেই রাজ্যের ঐতিহ্যকে প্রকৃত অর্থেই মাথায় করে রেখেছেন মোদী। কখনও মহারাষ্ট্রে পরেছেন শিবাজির টুপি, কখনও বা পঞ্জাবে গিয়ে বেঁধেছেন পাগড়ি। অরুণাচল প্রদেশে গিয়ে তাঁদের আদিবাসী শিরস্ত্রাণও পরতে দেখা গিয়েছে মোদীকে।
আবার বিভিন্ন রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী পোশাকেও দেখা গিয়েছে মোদী কাশ্মীরে গিয়ে ফেরনও পরেছেন প্রধানমন্ত্রী।
এই মোদীকেই সম্পূর্ণ অন্য অবতারে পাওয়া গিয়েছে স্বচ্ছ ভারত অভিযানে। সমুদ্রসৈকতে স্রেফ একটি সাধারণ কালো টিশার্ট আর ঢিলেঢালা প্যান্ট পরে ঝোলা হতে ময়লা সংগ্রহ করছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই পরিশ্রমে ঘামে জবজবে হয়ে যাওয়া টিশার্ট পরা মোদীর ছবি দেখলে প্রধানমন্ত্রীকে চেনাই যাবে না।
যদিও রাজনীতির কারবারিরা বলেন, এই সব আসলে রাজনীতিরই অঙ্গ। মোদী পোশাক দিয়েও রাজনীতি করেন। আর তা করেন বিশেষ রাখঢাক না করেই। মোদী-পন্থীরা অবশ্য বলেন পোশাকে রাজনীতি করতে গেলেও ফ্যাশন বোধ এবং সচেতনতা প্রয়োজন। মোদীর সেটা আছে। সেটা একটা গুণ। তা না হলে মোদীকে দেখে তো অনেকেই এই পোশাক রাজনীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন! সে ভাবে সফল হয়েছেন ক’জন?