এক অস্ত্রেই একদা ‘চিরশত্রু’ ফ্রান্সকে ঘায়েল করেছিল অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একাধিক অত্যাধুনিক অস্ত্রের ভিড়ে একমাত্র এই অস্ত্রটিকেই ‘সুপার উইপন’ বলে দাবি করেছিলেন সমর বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
পরমাণু বোমা নয়, কথা হচ্ছে বিশ্বের ‘সবচেয়ে বড়’ কামান গুস্তাভকে নিয়ে। ১৯৩৬ সালে এটি তৈরি করেছিল জার্মান সংস্থা ‘ক্রুপ’। কিন্তু জার্মান সেনাবাহিনীতে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল কয়েক বছর পরে, ১৯৪০ সালে।
কামানটি চওড়ায় ৭.১ মিটার এবং দৈর্ঘ্যে ৪৭.৩ মিটার। এটির ওজন ছিল ১৩৫০ টন। কেবল কামানের নলটিরই মাপ ছিল ১০০ ফুট! প্রয়োজনে ৪৬ কিমির বেশি দূরের লক্ষ্যবস্তুতে সাত টনের গোলা ছুড়তে পারত গুস্তাভ।
জার্মানির আগ্রাসন আটকাতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে, ১৯২৯ সালে ‘ম্যাগিনট লাইন’ নামের সুদীর্ঘ দুর্গ তৈরি করেছিল ফ্রান্স। ৪৫০ কিমি দীর্ঘ এই দুর্গ একেবারে ইংলিশ চ্যানেল থেকে বিস্তৃত ছিল জার্মানির সীমান্ত পর্যন্ত।
দুর্গটি তৈরি করতে সাড়ে পাঁচ কোটি টন ইস্পাত ব্যবহার করেছিল ফরাসিরা। ফ্রান্স এই দুর্গকে দুর্ভেদ্য মনে করলেও গুস্তাভ দিয়ে সেটিকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল জার্মানি।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হিটলার যখন ফ্রান্স আক্রমণের পরিকল্পনা করছেন, তখন ‘ম্যাগিনট লাইন’ সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। তাই নাৎসি নেতৃত্বকে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, এমন অস্ত্র বানাতে হবে যা গুঁড়িয়ে দেবে ফরাসি দুর্গকে।
প্রস্তুতি সেরে রেখেছিল ফ্রান্সও। ‘ম্যাগিনট লাইন’-এর ও পারে প্রায় ৫০০০ বাঙ্কার, সেনা ব্যারাক, এমনকি সেনাদের চলাচলের জন্য ভূগর্ভস্থ রেলপথও বানিয়ে ফেলেছিল ফরাসিরা।
কেবল গুস্তাভ কামানের সৌজন্যে ফ্রান্সের সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছিল জার্মানি। তবে কেবল ফ্রান্সের বিরুদ্ধেই নয়, এই সমরাস্ত্র চমৎকারিত্ব দেখিয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধেও।
সোভিয়েতের গুরুত্বপূর্ণ শহর (অধুনা ইউক্রেনে অবস্থিত) সেবাস্তোপোল শহরে ১৯৪২ সালে একটানা ৪৭ বার গোলা ছুড়েছিল কামানটি। অত্যধিক গরম হয়ে যাওয়ার কারণে শেষে কামানের নলটিই ছিটকে বেরিয়ে যায়। বদলে ফেলতে হয় সেটিকে।
সেই সময় সোভিয়েতের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন বারবারোসা’ শুরু করেছেন হিটলার। নাৎসি নেতা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ভাবে যেটুকু সাফল্য পেয়েছিলেন, তা এই গুস্তাভের জন্যই।
অবশ্য সমস্যাও ছিল অনেক। কামানটির ছিল লোহার চাকা। লোহা দিয়ে নির্মিত রেললাইনের উপর দিয়েই কেবল চলতে পারত কামানটি।
কামানটির বিশাল দৈর্ঘ্য এবং ওজনও জার্মান সেনাকে বিপাকে ফেলেছিল। শত্রুপক্ষের নজর এড়িয়ে কামানটিকে লুকিয়ে রাখা যেত না।
কামানটি চালনা করার খরচ তো বিপুল ছিলই, কেবল সেটিকে সচল রাখার জন্যই কমপক্ষে ২০০০ জনকে প্রয়োজন হত। যুদ্ধক্ষেত্রে এত বিপুল পরিমাণ লোকবলের জোগান অনেক সময়ই দিতে পারেনি জার্মান সেনা।
জার্মান সেনার একটি সূত্র মারফত সে সময় জানা গিয়েছিল, কামানটির প্রতি অন্ধবিশ্বাস ছিল হিটলারের। এই কামানে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল ‘ডোরা’ নামের বিশেষ গোলা।
ওই সূত্র মারফত জানা যায়, ‘ডোরা’ প্রস্তুত করতে জার্মান সেনা এত সময় খরচ করেছিল যে, স্তালিনগ্রাদে জার্মান সেনাকে ঘিরে ধরার সুযোগ এবং সময় পেয়ে গিয়েছিল সোভিয়েত সেনা। প্রত্যাঘাতের কোনও সুযোগই পায়নি হিটলারের বাহিনী।