সকালে উঠে চোখ খুলে দেখলেন প্রাসাদে শুয়ে রয়েছেন। সেখানে শয়ে শয়ে পরিচারক। বাড়ির সামনে গাড়ির সারি। রাতারাতি হাতে এসে গিয়েছে শতাধিক বছরের পুরনো গুপ্তধন! গোটা দুনিয়ায় এ ধরনের গুপ্তধন স়ঞ্চয় বা উদ্ধারের ঘটনা কম নয়। আমেরিকার ভার্জিনিয়া প্রদেশের এ রকমই এক গুপ্তধনের চাবিকাঠি আজও অধরা মানুষের।
অষ্টদশ শতকের কথা। ভার্জিনিয়া প্রদেশে কয়েক কোটি ডলারের সোনা-রুপো, লুকিয়ে রেখেছিলেন আমেরিকার অ্যাডভেঞ্চারার টমাস বিল। গুপ্তধন কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, তার কোনও মানচিত্র রেখে যাননি বিল। বদলে গোপন সঙ্কেত রেখে গিয়েছিলেন। ২০০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই সঙ্কেতের পাঠোদ্ধার হয়নি।
গত ২০০ বছরে অনেক চেষ্টা হয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন টমাস বিল নামে কেউ কখনও ছিলেন না। অনেক অভিযানকারী মনে করেন, বিলের রেখে যাওয়া সম্পদ বহু যুগ আগেই লোকজন মাটি খুঁড়ে হাতিয়ে নিয়েছে। সঙ্কেতের পাঠোদ্ধারও হয়ে গিয়েছে। অনেকে আবার হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, সঙ্কেতের ধাঁধার পাঠোদ্ধার সম্ভব নয়। কিন্তু আসল সত্যিটা আজও অধরা।
টমাস বিল ছিলেন ভার্জিনিয়ার বাসিন্দা। অষ্টদশ শতকের শুরুতে ৩০ জন শিকারি, খননকারী এবং অভিযাত্রীদের নিয়ে আমেরিকার পশ্চিমের দিকে যাত্রা করেছিলেন তাঁরা। মেক্সিকো অঞ্চলে একের পর এক মহিষ শিকার করেছিলেন তাঁরা। যদিও লক্ষ্য ছিল সোনার খনি উদ্ধার। অনেক খোঁজের পরেও মিলছিল না খনি।
শেষে সান্তা ফে এলাকায় একটি সোনা এবং রুপোর খনির হদিস পান বিলরা। এর পর ১৮ মাস ধরে খনন চালিয়ে কোটি কোটি টাকার সোনা-রুপো উদ্ধার করে দলটি। বিলের ইচ্ছা ছিল উদ্ধার হওয়া সোনা-রুপো নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু বাকিরা রাজি হননি। তাঁরা আরও সোনা-রুপোর খনির হদিস পেতে চাইছিলেন।
শেষ পর্যন্ত বিল নিজের ভাগের সোনা-রুপো নিয়ে ভার্জিনিয়া ফিরে আসেন। সেখানকার বেডফোর্ড কাউন্টির মন্টভেলে সে সব পুঁতে দেন।
১৮২২ সালে আবার পশ্চিমে অভিযানের ডাক পড়ে বিলের। বুঝতে পারেন নিজের ধনসম্পদ নিয়ে আর পশ্চিমে পাড়ি দিতে পারবেন না তিনি। তাই লুকিয়ে রাখা সম্পদের হদিস জানিয়ে তিনটি সঙ্কেত তৈরি করেন। প্রথমটিতে রয়েছে সম্পদ লুকিয়ে রাখার ঠিকানা। দ্বিতীয় সঙ্কেতে লেখা রয়েছে, সম্পদের হিসাব। তৃতীয় সঙ্কেতে বলা হয়েছে, ওই সম্পদ উদ্ধার হলে তার মালিক কে হবেন।
সেই সঙ্কেত একটি লোহার বাক্সে ভরে তা স্থানীয় এক সরাইখানার মালিককে দিয়ে যান বিল। সরাইখানার মালিক রবার্ট মরিসকে পরের ১০ বছর পর্যন্ত সেই বাক্স নিজের জিম্মায় রাখতে বলেন। ১০ বছরের মধ্যে তিনি না ফিরলে তখনই খুলতে বলেন সেই বাক্স।
কয়েক মাস পর মিসৌরির সেন্ট লুই থেকে মরিসকে একটি চিঠি লিখেছিলেন বিল। বলেছিলেন, সেই সঙ্কেতের বাক্স নিতে তাঁর এক বন্ধু আসবেন। তাঁর হাতেই যেন মরিস তুলে দেন সেই বাক্স। যদিও শেষ পর্যন্ত কেউ আসেননি।
শেষ পর্যন্ত ১৮৪৫ সালে সেই লোহার বাক্স খোলেন মরিস। দেখেন, তাতে রয়েছে তিনটি সঙ্কেত। সঙ্গে ইংরেজিতে লেখা দু’পাতার নোট। অনেক চেষ্টার পরেও কিছুই বুঝতে পারেননি মরিস।
নিজের এক বন্ধুর কাছে নিয়ে যান সঙ্কেত রাখা সেই বাক্স। কয়েক মাসের চেষ্টায় দ্বিতীয় সঙ্কেতের অর্থ বার করেন সেই বন্ধু। বুঝতে পারেন, কত কোটি কোটি ডলারের সম্পদ লুকিয়ে রেখে গিয়েছেন বিল।
সেই তালিকা নেহাত মন্দ নয়। সঙ্কেত দেখে মরিসের বন্ধুর মনে হয়েছিল দু’টি জায়গায় দু’বারে সোনা-রুপো লুকিয়েছিলেন বিল। তালিকা অনুযায়ী, প্রথম জায়গায় ছিল ৪৬০ পাউন্ড সোনা। সঙ্গে ছিল প্রায় ১,৭৩০ কোজি রুপো।
তালিকা অনুযায়ী দ্বিতীয় জায়গায় ৮৬৫ কেজি সোনা লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন বিল। সঙ্গে ছিল প্রায় ৫৮৪ কেজি রুপো। সব মিলিয়ে প্রায় তিন টন সোনা-রুপো ও অন্য দামি গয়না রেখে গিয়েছিলেন বিল।
দ্বিতীয় সঙ্কেত থেকে আরও কিছু তথ্য বুঝতে পারেন মরিসের বন্ধু। বুঝতে পারেন, বিপুল সেই সম্পদ বেডফোর্ড কাউন্টির কোনও এক মাঠে মাটি থেকে ছ’ফুট গভীরে পোঁতা রয়েছে। জনপ্রিয় পানশালা বাফোর্ড থেকে সাড়ে ছ’কিলোমিটার দূরে রয়েছে সেই মাঠ।
যদিও প্রথম সঙ্কেতটি কোনও দিনই পাঠোদ্ধার করা যায়নি। সেখানেই লেখা ছিল, মাঠের ঠিক কোন জায়গায় পুঁতে দেওয়া হয়েছিল সেই সোনা-রুপো। কয়েক বছর পর মারা যান মরিস। সঙ্কেতের পাঠোদ্ধার তিনি আর করে যেতে পারেননি।
সঙ্কেতের মানে বোঝার দায়িত্ব নেন গবেষক জেমস বি ওয়ার্ড। তিনিও বুঝতে পারেননি প্রথম সঙ্কেতের মানে। ১৮৮৫ সালে সেই সঙ্কেত লিখে প্রচারপুস্তিকা ছাপান জেমস। তার পর সেই প্রচারপুস্তিকা গোটা ভার্জিনিয়ায় বিলি করে দেন তিনি। জানান, কেউ যদি সঙ্কেতের পাঠোদ্ধার করে সোনা-রুপোর হদিস দিতে পারেন, তা হলে সম্পদের মালিক হবেন তিনিই।
এর পর গোটা প্রদেশের মানুষ ভিড় জমান বেডফোর্ডে। যেখানে, সেখানে শুরু হয় অবৈধ খনন। কেটে ফেলা হয় গাছ। তাতেও সুরাহা হয়নি। মেলেনি সেই সম্পদ। অনেক বাসিন্দাই হতাশ হয়ে দাবি করেন, আসলে কিছুই রেখে যাননি বিল। পুরোটাই ধোঁকা।
এর পর বহু বছর কেটে গিয়েছে। কম্পিউটারের কোড ব্রেকিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে সঙ্কেত ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। লাভ হয়নি। দ্বিতীয় সঙ্কেত, যার পাঠোদ্ধার প্রায় ১৮০ বছর আগেই হয়ে গিয়েছে, সেটিরও ব্যাখ্যা দিতে পারেনি যন্ত্র। গবেষকদের মতে, দ্বিতীয় সঙ্কেত এত সহজ হলে প্রথম দু’টি এত কঠিন কেন হবে? তাঁদের দাবি, আসলে কোনও গুপ্তধনই ছিল না। আবার অন্য একটি পক্ষ মনে করে, সঙ্কেত দু’টি খুবই সহজ। সে কারণে তার পাঠোদ্ধার আগেই হয়ে গিয়েছে। বাকিরা অকারণে তা জটিল করে দেখছে আর গোলকধাঁধা তৈরি করছে।