১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল দেশের প্রধানমন্ত্রীর দেহ। ইন্দিরা গান্ধীকে খুন করেছিলেন তাঁরই দুই দেহরক্ষী।
ইতিহাসের পাতায় সেই দিন রক্তাক্ত হয়ে রয়ে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়েছে স্মৃতি। কিন্তু ইন্দিরার হত্যা এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এখনও দেশের রাজনীতিতে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্দিরার খুনি সেই দুই শিখ দেহরক্ষীর মধ্যে এক জনের পুত্র নতুন করে উঠে এসেছেন জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে। লোকসভায় পঞ্জাবের একটি আসন জিতে নিয়েছেন তিনি। তাঁকে নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে।
এ বারের লোকসভা নির্বাচনে পঞ্জাবে ভাল ফল করেছে কংগ্রেস। ১৩টির মধ্যে সাতটি আসনে জয় পেয়েছে তারা। তিনটি আসন পেয়েছে আম আদমি পার্টি। বিজেপি একটিও আসন পায়নি পঞ্জাবে।
পঞ্জাবের ফরিদকোট আসন থেকে এ বারের ভোটে লড়েছিলেন ৪৪ বছরের সর্বজিৎ সিংহ খালসা। তাঁর বাবা বেয়ন্ত সিংহ। যাঁর নাম জড়িয়ে আছে ইন্দিরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে।
তবে কংগ্রেস বা আপ নয়, বিয়ন্তের পুত্র নির্দল প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। ফরিদকোটে কংগ্রেস এবং আপ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছেন তিনি। কংগ্রেসের চেয়ে ৭০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন।
পঞ্জাবে এ বার দু’টি আসনে জয়ী হয়েছেন নির্দল প্রার্থীরা। দু’টিই বিতর্কিত। সর্বজিৎ ছাড়া খাদুর সাহিব আসন থেকে জয় পেয়েছেন বিচ্ছিন্নতাবাদী খলিস্তানি নেতা অমৃতপাল সিংহ। যিনি বর্তমানে জেলবন্দি।
এই প্রথম নয়, আগেও একাধিক বার ভোটে লড়েছেন সর্বজিৎ। যদিও জয় পেলেন এই প্রথম। তাঁর পরিবারে রাজনীতির ইতিহাস রয়েছে। সর্বজিতের পিতামহ সুচা সিংহ ভাতিণ্ডার সাংসদ ছিলেন।
২০০৪ সালে প্রথম ভাতিণ্ডা থেকে লোকসভা ভোটে লড়েছিলেন সর্বজিৎ। লক্ষাধিক ভোট পেলেও জিততে পারেননি। এর পর ২০০৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনেও প্রার্থী হন। সে বার ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ১৫ হাজার।
বার বার ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়েননি সর্বজিৎ। ২০০৯ সালে আবার ভাতিণ্ডা থেকে লড়েন। ২০১৪ সালে প্রার্থী হন ফতেগড় সাহিব লোকসভা কেন্দ্র থেকে। ২০২৪-এ এসে অবশেষে পেলেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।
ফরিদকোট কেন্দ্রে এ বার কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন পঞ্জাবের জনপ্রিয় অভিনেতা এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু করমজিৎ অনমোল। কিন্তু প্রায় তিন লক্ষ ভোট পেয়ে আসনটি জিতে নিয়েছেন নির্দল সর্বজিৎ।
১৯৮৪ সালে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির থেকে খলিস্তানি জঙ্গিদের সরাতে একটি সেনা অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা। তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। তার সূত্রেই সর্বজিতের পরিবার নাম লিখিয়ে ফেলে দেশের ইতিহাসে।
স্বর্ণমন্দিরে সেনা অভিযানে বহু শিখের মৃত্যু হয়েছিল, যা শিখ অধ্যুষিত পঞ্জাব ভাল চোখে দেখেনি। তার পর থেকেই ওই এলাকায় ইন্দিরাবিরোধী কার্যকলাপ শুরু হয়।
১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ইন্দিরাকে গুলি করে মারেন তাঁর দুই দেহরক্ষী— বিয়ন্ত সিংহ এবং সৎবন্ত সিংহ। ৩১ রাউন্ড গুলি চালানো হয়েছিল তাঁর উপর।
শোনা যায়, বিয়ন্ত তিন থেকে চার রাউন্ড গুলি চালিয়েছিলেন। বাকি গুলি চালিয়েছিলেন সৎবন্ত। ইন্দিরাকে মারার পর তাঁরা দু’জনেই অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
ঘটনাস্থল থেকেই একটি বন্ধ ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দুই আততায়ীকে। সেখানেই বিয়ন্তকে গুলি করে মারা হয় বলে অভিযোগ। পরে সৎবন্তের ফাঁসি হয় তিহাড় জেলে।
ইন্দিরার মৃত্যুর পর দেশ জুড়ে দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বহু শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষ সেই দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছিলেন ইন্দিরার পুত্র রাজীব গান্ধী।
পঞ্জাবের রাজনীতিতে নতুন করে উত্থান ঘটেছে ইন্দিরার খুনি সেই বিয়ন্তের পুত্রের। সংসদে শপথ নিতে যাবেন তিনি। তাঁর হাত ধরে পঞ্জাবের রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেটাই এখন দেখার।