গত পাঁচ মাস ধরে মহাকাশযানের ছোট্ট গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ সুনীতা উইলিয়ামসের দুনিয়া। এক দিন এক দিন করে মহাকাশে ১৫০ দিন পার করে ফেলেছেন সুনীতা ও তাঁর সঙ্গী বুচ উইলমোর। সম্প্রতি নাসার পক্ষ থেকে সুনীতার যে ক’টি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে তাতে সুনীতার জন্য উদ্বেগ বাড়ছে বই কমছে না বিশ্ববাসীর।
সময় যত এগোচ্ছে, বাড়ছে আশঙ্কাও। দীর্ঘ দিন ধরে মহাকাশে আটকে থাকায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে সুনীতা ও বুচের। যদিও নাসা বার বার দাবি করেছে, সুনীতা এবং ব্যারির প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা নেই।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সুনীতার যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত নভোচরের স্বাস্থ্যের বেশ অবনতি হয়েছে। এই পাঁচ মাসে তাঁর ওজন এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে, সুনীতাকে অত্যন্ত শীর্ণকায় লাগছে। দীর্ঘায়িত মহাকাশ সফরের কারণে এই শারীরিক অবনতি উদ্বেগ বাড়িয়েছে নাসারও।
সুনীতার স্বাস্থ্যের উপর কড়া নজর রাখছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। মূলত আট দিনের নির্ধারিত মহাকাশ সফরের পরিধি বেড়ে পাঁচ মাসে দাঁড়িয়েছে বোয়িং স্টারলাইনার মহাকাশযানের প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে। এই অভিযানের সঙ্গে নাসার যে সব কর্তা ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত, তাঁরাও সুনীতার শারীরিক অবস্থার অবনতি নিয়ে চিন্তিত বলে জানা গিয়েছে।
তাঁর ওজন দ্রুত স্থিতিশীল করা দরকার এবং এই মুহূর্তে সুনীতাদের স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন নাসার এক কর্তা। তিনি এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন।
৫ জুন ফ্লরিডা থেকে সুনীতাদের নিয়ে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল বোয়িং স্টারলাইনার। গন্তব্য ছিল মহাকাশে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন। সেই সময় সুনীতার ওজন ছিল ৬৩ কেজি।
দিন যতই গড়িয়েছে ওজন ক্রমেই কমেছে সুনীতার। মহাকাশে ওজন স্থিতিশীল রাখতে উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার খেতে হয় মহাকাশচারীদের।
শুধুমাত্র ওজন বজায় রাখার জন্য মহাকাশ সফরের সময় প্রতি দিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার ক্যালোরির খাবার খেতে হয় নভোচরদের। সেই পরিমাণ খাবার শরীরকে না দিলে শরীর ভাঙতে শুরু করে ও দ্রুত ওজন কমতে থাকে।
অতিরিক্ত ক্যালোরি খরচ করে পেশি এবং হাড় শক্তিশালী রাখতে মহাকাশচারীদের প্রতি দিন দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়।
সুনীতার সাম্প্রতিক ছবিগুলি প্রকাশ্যে আসার এক মাস আগেই নাসার চিকিৎসকেরা তাঁর স্বাস্থ্যের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলিতে বলা হয়েছিল। তাঁরা সুনীতার ওজন কমা নিয়ে বিশেষ ভাবে চিন্তিত ছিলেন।
নাসার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মহাকাশ ভ্রমণের সময় বিপাকের পরিবর্তনের কারণে পুরুষ নভোচরদের তুলনায় দ্রুত পেশি ক্ষয় অনুভব করেন মহিলা মহাকাশচারীরা।
শরীরের ওপর অভিকর্ষের নিরবচ্ছিন্ন টান না থাকায় মহাকাশে মানবদেহের পেশি ও হাড়ের ঘনত্ব দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। দুই সপ্তাহ পরেই পেশির ঘনত্ব ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ছয় মাস থাকলে তা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
খুব বেশি দিন মহাকাশে থাকলে দ্রুত হারে কমতে থাকে লাল রক্তকণিকার পরিমাণ। সে ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে রক্তাল্পতার মতো শারীরিক সমস্যাও। গবেষণা বলছে, মহাকাশে থাককালীন প্রতি সেকেন্ডে ২ লক্ষের বদলে ৩ লক্ষ লোহিত কণিকা ধ্বংস হয়ে যায় নভোচরদের।
নাসা জানিয়েছে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সুনীতাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। নতুন করে একটি মহাকাশযান পাঠানো হবে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে (আইএসএস)। তত দিন সুনীতারা সেখানেই থাকবেন। ফেব্রুয়ারিতে ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেস এক্সের ‘ক্রু ড্রাগন’ মহাকাশযানের মাধ্যমে তাঁদের ফিরিয়ে আনা হবে।
নাসার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি দিন কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা ঘুমোচ্ছেন সুনীতা ও বুচ। তাঁদের ওজন যাতে না কমে যায় তার জন্য পুষ্টিকর খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
নিজের শারীরিক সমস্যা নিয়েই অবশ্য মোটেই চিন্তিত নন সুনীতা। কিছু দিন আগে মহাকাশ থেকে সাংবাদিক বৈঠক করেন সুনীতারা। সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর তাঁরা দিয়েছেন। জানিয়েছেন, মহাকাশই তাঁদের ঘর। সেখানে থাকতে তাঁদের ভালই লাগছে।
এমনকি আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনেই নিজের ৫৯তম জন্মদিন কাটিয়ে ফেললেন সুনীতা। গত সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে পালন করেছেন নিজের জন্মদিন। তবে আয়োজন বলতে কিছুই ছিল না। নাসার দেওয়া বিশেষ কাজ করে জন্মদিন কেটেছে সুনীতার।
পৃথিবী থেকে ৪০০ কিলোমিটার উপরে আইএসএসে রয়েছেন সুনীতারা। সেখানে বসেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন তিনি। সেই বন্দোবস্ত করেছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা। ১৯৯৭ সাল থেকে মহাকাশে বসে আমেরিকার ভোটে অংশ নিতে পারেন সে দেশের নাগরিক-মহাকাশচারীরা। সে বছর টেক্সাসের আইনসভা একটি বিল পাশ করেছিল, যাতে নাসার মহাকাশচারীরা মহাকাশে বসেই ভোট দিতে পারেন।