অবশেষে ‘যুদ্ধের’ সমাপ্তি! সোমবার এসএসসি (স্কুল সার্ভিস কমিশন) মামলায় রায় ঘোষণা করল কলকাতা হাই কোর্ট। এই মামলার সঙ্গে জড়িত কত নাম যে গত তিন বছরে শুনেছে রাজ্যবাসী, তার ইয়ত্তা নেই! তাঁরা সমাজের নানা স্তর থেকে উঠে আসা। ভাষা-মতেও বিস্তর ফারাক তাঁদের মধ্যে। তাঁদের অনেকের নাম থেকে গিয়েছে। আবার কত নাম হারিয়েও গিয়েছে এত দিনে! উঠে এসেছে বহু নতুন চরিত্র। আবার কত পুরনো চরিত্রেরও আবির্ভাব হয়েছে নতুন মোড়কে! কিন্তু এসএসসি মামলার মুখ্য চরিত্রে কারা রয়ে গেলেন, সেই তালিকা তৈরি করল আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়— এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। পরে নিয়োগ দুর্নীতির আরও সাতটি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি। শেষ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন ২০২২ সালের ১৭ মে। নিয়োগ মামলায় তাঁর কিছু পদক্ষেপ বিশেষ ভাবে চর্চিত। যেমন, রাত ১১টায় কোর্ট বসিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে এসএসসি দফতর ঘেরাওয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, নিয়োগ মামলায় কমবেশি পাঁচ হাজার চাকরি বাতিলেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। পরে ধাপে ধাপে সেই সব নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সোমবার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শাব্বার রশিদির বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ কার্যত প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশই বহাল রাখল। বরং আরও বেশি চাকরি বাতিল করল। উচ্চ আদালতের বিশেষ বেঞ্চ এসএসসি মামলার রায়ে সব মিলিয়ে মোট ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল করেছে সোমবার। অর্থাৎ, ২০১৬ সালে যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের সকলের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্যানেলের মেয়াদ শেষের পরে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, জনগণের টাকা থেকে বেতন নিয়েছেন, তাঁদের চার সপ্তাহের মধ্যে সুদ-সহ বেতন ফেরত দিতে হবে। বছরে ১২ শতাংশ সুদে টাকা ফেরত দিতে হবে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়— ১৮ মে, ২০২২। নবম-দশমে নিয়োগ মামলায় প্রথম সরাসরি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম কলকাতা হাই কোর্টে ওঠে। পার্থকে সিবিআই দফতরে হাজিরার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। পার্থ হাজিরাও দেন। তার তিন মাস পর ২৩ জুলাই তারিখে ইডির হাতে গ্রেফতার হন পার্থ। তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দু’টি ফ্ল্যাট থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা উদ্ধার করেছিল ইডি। তার পরেই গ্রেফতার করা হয় প্রাক্তন মন্ত্রীকে। এখনও তিনি জেলবন্দি।
আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য— ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম বার নিয়োগ দুর্নীতির কথা আদালতের গোচরে আনেন আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য। সেটি গ্রুপ ডি-তে নিয়োগের মামলা ছিল। বিকাশের সঙ্গী ছিলেন তাঁর ‘জুনিয়র’ ফিরদৌস শামিম এবং সুদীপ্ত দাশগুপ্ত। পরে ওই বছরই ৮ নভেম্বরে গ্রুপ সি-র মামলা শুরু হয়। চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে সুপ্রিম কোর্টেও মামলা লড়েছেন বিকাশ। নিয়োগ মামলায় লড়তে গিয়ে তাঁকে বেশ কয়েক বার বিক্ষোভের মুখেও পড়তে হয়েছে।
শান্তিপ্রসাদ সিংহ— নিয়োগ মামলায় শান্তিপ্রসাদ সিংহকে ‘দুর্নীতির কিংপিন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি মামলায় শান্তিপ্রসাদের নাম ওঠে। ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম বার সিবিআই দফতরে হাজিরা দেন তিনি। শান্তিপ্রসাদ এসএসসির উপদেষ্টা কমিটির মাথায় ছিলেন। অভিযোগ ওঠে, তাঁর নির্দেশেই শিক্ষা দফতরের একাধিক আধিকারিক বেআইনি ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন।
অঙ্কিতা অধিকারী— রাজ্যের শিক্ষা দফতরের প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী পরেশচন্দ্র অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর নাম আদালতে প্রথম ওঠে ২০২২ সালের ১৭ মে। অভিযোগ ওঠে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিকা পদে তাঁর নিয়োগ বেআইনি। এর পরেই অঙ্কিতা এবং তাঁর পিতা পরেশকে সিবিআই দফতরে হাজিরার নির্দেশ দেন প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই মতো কোচবিহারের মেখলিগঞ্জের বাসিন্দা পরেশ এবং অঙ্কিতা কলকাতায় আসার জন্য ট্রেনেও চেপেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কলকাতায় পৌঁছননি ওই দিন। ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিলেন! পরে জানা যায়, তাঁরা বর্ধমানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য দু’জনকেই সিবিআইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। নিয়োগ মামলায় নাম জড়ানোর পরেই পরেশকে মন্ত্রিপদ থেকে সরানো হয়। এর সুপারিশ করেছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। চাকরি যায় অঙ্কিতারও। সেই চাকরি পান ববিতা সরকার।
ববিতা সরকার— অঙ্কিতার নিয়োগের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন ববিতাই। সেই মামলায় জিতে অঙ্কিতার চাকরি এবং তাঁর বেতন বাবদ পাওয়া ১৪ লাখ টাকা পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ববিতার চাকরিও স্থায়ী হয়নি। তাঁরও চাকরি যায়। সেই চাকরি পান অনামিকা রায়। ববিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, আবেদনপত্রে নিজের নম্বর বেশি দেখিয়েছিলেন তিনি।
অনামিকা— ববিতার নিয়োগের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন অনামিকা। পরে সেই মামলায় ববিতার চাকরি এবং অঙ্কিতার থেকে পাওয়া সেই ১৪ লাখ টাকাও অনামিকা পেয়েছিলেন। এখন তিনি শিক্ষকতা করেন।
সুতনু পাত্র— এসএসসির আইনজীবী ছিলেন সুতনু পাত্র। মামলা শুনানির সময় তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান বদলের অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ ছিল, তিনি একক বেঞ্চে এক কথা বলতেন, আর ডিভিশন বেঞ্চে গিয়ে বলতেন অন্য কথা! পরে অবশ্য আদালতের নির্দেশ মেনে সব রকম সহযোগিতা করেছিলেন সুতনু। আদালতের হাতে অনেক নথিপত্র তুলে দিয়েছিলেন। এ সব কারণে তাঁকে ‘দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি’ আখ্যাও দিয়েছিল আদালত। সুতনু আদালতে অভিযোগ করেছিলেন, এসএসসির সুপারিশ মেনে অনেক সময় নিয়োগ দেয়নি মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। তা নিয়ে আদালতে পর্ষদের আইনজীবীর সঙ্গে তর্কাতর্কিতেও জড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছিল সুতনুকে।
সোমা দাস— প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশেই চাকরি পেয়েছিলেন নবম থেকে দ্বাদশের চাকরিপ্রার্থী ক্যানসার আক্রান্ত সোমা দাস। ২০১৬ সালে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের (এসএলএসটি) পরীক্ষায় বসেছিলেন তিনি। তাঁর অভিযোগ ছিল, মেধাতালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও তাঁকে চাকরি দেওয়া হয়নি। চাকরির দাবিতে রোদ, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অসুস্থ সোমা দিনের পর দিন কলকাতার রাস্তায় ধর্না, অবস্থান-বিক্ষোভ করেছিলেন। ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সোমাকে শিক্ষকতার চাকরির বদলে অন্য সরকারি চাকরি গ্রহণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সোমা সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। পরে বিচারপতি তাঁকে জানান, ভবিষ্যতে যদি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার কোনও শূন্যপদ থাকে, তবে সোমাকে তা দেওয়া হবে। পরে আদালতের সুপারিশে শিক্ষকতার চাকরি পান সোমা।
বিচারপতি হরিশ টন্ডন— বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিবিআই তদন্তের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ দিয়েছিল বিচারপতি হরিশ টন্ডনের ডিভিশন বেঞ্চ। বিচারপতি টন্ডন ও বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তের ডিভিশন বেঞ্চই নিয়োগে দুর্নীতির অনুসন্ধানের জন্য ‘বাগ কমিটি’ গঠন করে। কিন্তু এই ডিভিশন বেঞ্চের বিরুদ্ধে বার বার বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ করেন অভিজিৎ। সুপ্রিম কোর্টেও আর্জি জানান যে, ওই ডিভিশন বেঞ্চের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হোক। এর পরেই এসএসসি মামলা থেকে সরে যায় বিচারপতি টন্ডনের বেঞ্চ। তার পর আরও চারটি বেঞ্চ ওই মামলা গ্রহণ করেনি।
বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু— নিয়োগ মামলায় হাই কোর্টের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শীর্ষ আদালতে এই মামলার বিচার করেছিল বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসুর ডিভিশন বেঞ্চ। ওই বেঞ্চই হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমকে একটি বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ গঠন করার নির্দেশ দেয়। নির্দেশ ছিল, হাই কোর্টের ওই বেঞ্চই ছ’মাসের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করে রায় দেবে। বিচারপতি বসুর বেঞ্চই সিবিআইকে দু’মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিল।
বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শাব্বার রশিদি— সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বসুর বেঞ্চের নির্দেশ মেনে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম এসএসসির সব মামলাই বিচারপতি বসাক এবং বিচারপতি রশিদির বিশেষ বেঞ্চে পাঠান শুনানির জন্য। এই বেঞ্চ ১২ ডিসেম্বর থেকে মামলার শুনানি শুরু করে। নিয়মিত শুনানি চলে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে ছ’মাসের মধ্যে শুনানি প্রক্রিয়া শেষ করে এই বেঞ্চ। শেষ শুনানি ছিল ২০ মার্চ। তার এক মাসের মাথায় সোমবার ২২ এপ্রিল রায় ঘোষণা করল বিচারপতি বসাক এবং বিচারপতি রশিদির বিশেষ বেঞ্চ।
রঞ্জিতকুমার বাগ— নিয়োগ দুর্নীতির প্রাথমিক সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের অনুসন্ধান রিপোর্টে। প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চ বাগ কমিটি গঠন করে অনুসন্ধান করতে বলেছিল। সেই মতো অনুসন্ধান করে বাগ কমিটি জানিয়েছিল, নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে। বেশ কয়েক জন চাকরিপ্রাপককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করেছিল এই কমিটি। এসএসসির উপদেষ্টা কমিটির বিরুদ্ধেও আইনি পদক্ষেপ করার সুপারিশ করেছিল তারা। বাগ কমিটিই প্রথম জানিয়েছিল যে, মেয়াদ-উত্তীর্ণ প্যানেলেও অনেকের চাকরি হয়েছে। বাগ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে অনেকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়— এসএসসি নিয়োগ মামলার প্রথম পর্যায়ে ছিলেন না কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে তিনি এই মামলা লড়তে শুরু করেন। হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চে তিনি চাকরিপ্রাপকদের হয়ে সওয়াল করেন। কল্যাণ প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন সিবিআই তদন্তের নির্দেশ নিয়েও। সিবিআই যে প্রক্রিয়ায় এসএসসি মামলার তদন্ত করেছে, তার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন কল্যাণ।
আব্দুল গনি আনসারি— নবম-দশম শ্রেণিতে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ তুলে হাই কোর্টে মামলা করেছিলেন আব্দুল গনি আনসারিই। তাঁর মামলাটি প্রথমে ছিল বিচারপতি সৌগত ভট্টাচার্যের এজলাসে। পরে ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মামলাটি প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে যায়। তাঁর মামলাতেই শান্তিপ্রসাদকে সিবিআই দফতরে হাজিরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। একই মামলায় পার্থকেও সিবিআই দফতরে হাজিরার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আন্দোলনকারী— কলকাতায় গান্ধীমূর্তির পাদদেশে দিনের পর দিন চাকরির দাবিতে আন্দোলন চালিয়েছেন এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন অমিত ঘোষ, শেতাব উদ্দিন, সন্দীপ প্রসাদ।