দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, বিশেষত ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনের আধিপত্য সর্বজনবিদিত। তার ভারতকে সমস্যায় ফেলার প্রবণতা নিয়েও কম আলোচনা হয়নি। সম্প্রতি একটি ঘটনায় আবার সেই আলোচনা শুরু হয়েছে।
ভারতের এক পড়শি দেশে ৪৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিন। ভারতীয় মুদ্রায় যার মূল্য ৩৭ হাজার কোটি টাকা। সে দেশের সরকার চিনের এই বিনিয়োগে ছাড়পত্র দিয়েছে সোমবারই। এ বার শুরু হবে কাজ।
কথা হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে। শ্রীলঙ্কার বাজারে চিন প্রবেশ করেছিল চলতি বছরের জুলাই মাসে। চিনা তৈলশোধনকারী সংস্থা সিনোপেক শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগ করতে চলেছে।
শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা দ্বীপে একটি বড় তৈলশোধনাগার তৈরি করবে চিনা সংস্থা। সোমবার সিনোপেককে সে বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভা। ফলে শ্রীলঙ্কার মাটিতে কাজ শুরু করতে চিনের আর কোনও বাধা রইল না।
হামবানটোটায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার যে তৈলশোধনাগার চিন তৈরি করবে, সেখানে তেলের ব্যবসা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী কাঞ্চন উইজেসেকারা।
শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর হামবানটোটা। কলম্বোর পরেই তার স্থান। ভূ-রাজনীতিগত দিক থেকেও এই দ্বীপের গুরুত্ব রয়েছে। ভারত মহাসাগরে এই দ্বীপ নিয়ে তাই অতীতেও কম চর্চা হয়নি।
এই দ্বীপের বন্দরে অবশ্য চিনের আধিপত্য দীর্ঘ দিনের। বন্দরটি ২০১০ সালে তৈরি করা হয়। ২০১৭ থেকে তা শ্রীলঙ্কান বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং চিনের একটি বন্দর গোষ্ঠীর যৌথ পরিচালনার অধীনে রয়েছে। চিনা গোষ্ঠীর নাম হামবানটোটা আন্তর্জাতিক বন্দর গোষ্ঠী।
চিনা ব্যাঙ্ক থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নিয়েই হামবানটোটা দ্বীপে বন্দর গড়ে তোলা হয়েছিল। ২০১৭ সালে চিনা গোষ্ঠীকে এই বন্দর ৯৯ বছরের জন্য লিজ়ে দিয়ে দেয় শ্রীলঙ্কার সরকার। ওই বন্দরে বাণিজ্যিক লেনদেন-সহ যাবতীয় কার্যকলাপে চিনের অনুমতি প্রয়োজন।
হামবানটোটায় সিনোপেকের তৈলশোধনাগার তৈরি হয়ে গেলে শ্রীলঙ্কার তেলের বাণিজ্যে চিনের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে, ভারতকে টপকে শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্য করবে চিন।
কয়েক বছর আগে পর্যন্তও শ্রীলঙ্কার তেলের ব্যবসায় আধিপত্য ছিল ভারতের। দেশের মধ্যে অন্যতম পরিচিত নাম এখনও লঙ্কা আইওসি (লঙ্কা ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন)। যা ভারতের ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের একটি শাখা। এত দিন সেখানে এই সংস্থারই একচেটিয়া বাজার ছিল।
২০০৩ সালে শ্রীলঙ্কায় পা রাখে ইন্ডিয়ান অয়েল। সেই থেকে যাত্রা শুরু। কিছু দিনের মধ্যেই দেশের পেট্রল এবং ডিজ়েলের ব্যবসার ১৬ শতাংশে আধিপত্য কায়েম করেছিল তারা।
এ ছাড়া, লুব্রিক্যান্ট, বিটুমিন, বাঙ্কারিংয়ের মতো সামুদ্রিক জ্বালানির বাজারেও ৩৫ শতাংশ অধিগ্রহণ করেছিল ভারতীয় শোধন সংস্থা। যাত্রা শুরুর মাত্র এক বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় তারা জায়গা পাকা করে ফেলে।
চলতি বছরে শ্রীলঙ্কায় ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছে ইন্ডিয়ান অয়েল। তারা সেখানে পেট্রল পাম্পের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। তাতে চিনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
বস্তুত, তেলের ব্যবসায় আর শুধু ভারতীয় সংস্থার উপর ভরসা করে থাকতে চাইছে না শ্রীলঙ্কা। গত বছর তারা যে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিল, তা একটু সামলে উঠতেই বাজার সম্প্রসারণে মন দিয়েছে কলম্বো। আরও বেশি সংস্থার সামনে শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যের দিগন্ত উন্মোচন করাই সরকারের লক্ষ্য।
এ কথা দীর্ঘ দিন ধরেই চর্চিত যে, ভারতকে চাপে ফেলতে এবং সমু্দ্রে আধিপত্য কায়েম করতে চিনের লক্ষ্য শ্রীলঙ্কা, বিশেষত হামবানটোটা। শ্রীলঙ্কা এখনও পর্যন্ত বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে। সেখানে ক্রমে প্রভাব বিস্তার করছে চিন।
হামবানটোটা বন্দরে চিনের তৈলশোধনাগার তৈরি হলে ওই এলাকায় বেজিংয়ের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে। ভারতকে সমস্যায় ফেলতে চিন ওই বন্দর ব্যবহার করবে কি না, তা সময় বলবে।