চল্লিশটি বসন্তও গড়ায়নি। তার মধ্যেই জীবনের বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন। তবে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লেও আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন স্মাইলি সুরি। বলিউডের হাজারো নায়িকার ভিড়ে আজ যিনি বিস্মৃতপ্রায়।
বলিউডি পর্দায় যাত্রা শুরুর আগে থেকেই নাকি বাধার মুখে পড়েছিলেন স্মাইলি। তা-ও আবার নিজের এক আত্মীয়ের কাছ থেকে। সে আত্মীয় আর কেউ নন— পূজা ভট্ট।
ছোটবেলা থেকেই লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের মতো শব্দের সঙ্গে পরিচিতি ছিল স্মাইলির। ভট্ট পরিবারের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। স্মাইলির তুতো দিদি হলেন মহেশ ভট্ট-কন্যা পূজা ভট্ট।
পূজা ছাড়া ইমরান হাশমি তাঁর দূরসম্পর্কের আত্মীয়। আবার পরিচালক মোহিত সুরি হলেন স্মাইলির ভাই। এ হেন ‘ফিল্মি’ পরিবারের কন্যা যে অভিনয়কেই পেশা হিসাবে বেছে নেবেন, সেটাই যেন স্বাভাবিক।
স্মাইলিও অভিনয়ে মন দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর জন্য সে মঞ্চও তৈরি করতে শুরু করেছিলেন পূজা। মহেশ-কন্যার পরিচালিত ‘হলিডে’তে মুসকানের চরিত্রে স্মাইলিকেই বেছেছিলেন তিনি। ফলে বলিউডে অভিষেকের অনায়াস সুযোগ এসে গিয়েছিল স্মাইলির কাছে।
অভিষেকের স্বপ্নে বুঁদ স্মাইলির স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। ওই ছবির জন্য সইসাবুদের পর পূজার পরিচালনায় শুটিংও শুরু করে দিয়েছিলেন। তবে বেশ কিছু দিন শ্যুটিংয়ের পর নাকি স্মাইলিকে নিজের ছবি থেকে সরিয়ে দেন পূজা।
প্রথম ছবি শুরু হওয়ার আগেই হোঁচট খেয়েছিল স্মাইলির কেরিয়ার। বলিউডে কানাঘুষো, অভিনয় নাকি করতেই পারেন না স্মাইলি। সে জন্যই তাঁকে ‘হলিডে’ থেকে বাদ দেন পূজা। ২০০২ সালে নাকি সে ছবি মুক্তির কথা ছিল। তবে নানা কারণে তা পিছিয়ে যায়।
স্মাইলির বদলে পূজার সে ছবিতে সুযোগ পান অঞ্জলি নায়ার। তবে তত দিনে নাকি স্মাইলির অভিনয় দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০০৬ সালে দিনো মোরিয়া এবং মুনমুন দত্তের পাশাপাশি ‘হলিডে’তে দেখা গিয়েছিল অঞ্জলিকে।
বক্স অফিসে মুনাফার নিরিখে অবশ্য শেষ হাসি হেসেছিলেন স্পাইলি। পূজার ‘হলিডে’ একেবারেই জমেনি। অন্য দিকে, ওই ছবি মুক্তির আগের বছরেই বলিউডে সাড়াজাগানো অভিষেক হয় স্মাইলির।
পূজার ছবি থেকে বাদ পড়ার পর নিজের ছবিতে দিদিকে নায়িকা হিসাবে নিয়ে আসেন মোহিত। ২০০৫ সালে মুক্তি পায় ‘কলযুগ’। নায়িকার মতো নায়ক কুণাল খেমুরও অগ্নিপরীক্ষা ছিল সে ছবি।
‘স্যর’, ‘হম হ্যায়ঁ রাহী প্যায়ার কে’, ‘রাজা হিন্দুস্তানী’, ‘তম্মান্না’, ‘জখ্ম’— একের পর এক ছবিতে শিশুশিল্পী হিসাবে নিজের অভিনয়দক্ষতার পরিচয় আগেই দিয়েছিলেন কুণাল। ২০০৫ সালে নায়কের ভূমিকায়ও অনেকে চমকে দেন তিনি।
কুণালের পাশাপাশি চমক দিয়েছিলেন স্মাইলিও। গ্ল্যামারহীন, পাশের বাড়ির মেয়ের ইমেজে ধরা পড়লেও কুণালের সঙ্গে তাঁর জুটি মনে ধরেছিল সমালোচক থেকে দর্শকদের। ‘আদত’, ‘জিয়া ধড়ক ধড়ক’, ‘তুঝে দেখ দেখ’— পরের পর সুপারহিট গানেও মাতিয়েছিল সে ছবি।
‘কলযুগে’র পর স্মাইলির ৪টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ষষ্ঠ ছবির শ্যুটিং করলেও তা মুক্তি পায়নি। তার মধ্যে ছিল ‘ইয়ে মেরা ইন্ডিয়া’ এবং ‘ক্রুক’-এর মতো ছবি। তবে কোনও ছবিতে সাড়া ফেলতে পারেননি স্মাইলি। ২০০৫ সালে বলিউডে অভিষেকের ৩ বছরের মধ্যে তাঁর কেরিয়ার তলিয়ে যায়। তবে নাচের মধ্যেই নতুন ভালবাসা খুঁজে পান স্মাইলি।
শামক ডাবরের নাচের ক্লাসে বছর পাঁচেক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি। আগে থেকেই কত্থকের তালিম নিয়েছেন গুরু বিজয়শ্রী চৌধরির কাছে। লাতিন এবং বলরুম ডান্সের ছন্দে মেতেছিলেন সন্দীপ সোপরকরের গ্রুপে। অভিনয়ের থেকে যেন নাচ করতেই ভালবাসতেন স্মাইলি!
বড় পর্দায় অভিনয়ে নাম কামানোর স্বপ্ন ধূসর হতে শুরু করলে টেলিভিশনের পা রাখেন তিনি। ‘জোধা আকবর’ ধারাবাহিকে আকবরের স্ত্রীর ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। সেটা ছিল ২০১৩ সাল।
সে সময় সালসা শিখতে শুরু করেছিলেন স্মাইলি। বিনীত বঙ্গেরা ছিলেন তাঁর প্রশিক্ষক। কে জানত, পরে তিনিই স্মাইলির জীবনসঙ্গী হবেন! নাচের ক্লাসের বাইরে দু’জনের প্রেমও গাঢ় হতে শুরু করেছিল। ‘নাচ বলিয়ে’-র সপ্তম মরসুমে তো দু’জনে একসঙ্গে টিভির পর্দায় ধরা দিয়েছিলেন।
২০১৪ সালের জুলাইয়ে বিনীতের হাতে হাত রেখে নতুন সফর শুরু করেন স্মাইলি। তবে বছর চারেকের মধ্যেই সে সফরেও ইতি টেনে দেন বিনীত। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের ধাক্কা সহ্য করতে পারেননি স্মাইলি। জীবন থেকে বিনীতের সরে যাওয়ায় জন্যই নাকি মানসিক অবসাদে ডুবে যান। উদ্বেগজনিত সমস্যাও দেখা দিতে শুরু করে। ওজনও বেড়ে যায় স্মাইলির।
মানসিক অবসাদ কাটাতে আর অনেক কিছুর সঙ্গে নাচের নেশাকেও কাজে লাগিয়েছিলেন স্মাইলি। সে সময় থেকেই মনের জোর বাড়াতে পোল ডান্স শিখতে শুরু করেন। বহু বছর পর ‘বম্বে টাইমসে’র কাছে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘এক সময় অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিলাম। মানসিক স্থিতাবস্থা ফিরে পেতে পোল ডান্স শেখার দিকে ঝুঁকি।’’
পোল ডান্সের মাধ্যমেই জীবনে ঘুরে দাঁড়ান স্মাইলি। ধীরে ধীরে পোল ডান্সের প্রশিক্ষণও দিতে শুরু করেন। মুম্বইয়ের ব্রান্দ্রা এবং চেম্বুরে ২টি স্কুলও খুলেছেন তিনি।
বলিউডি জগৎ থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন স্মাইলি। অবসাদের মতো উপসর্গের বিরুদ্ধে লড়াইও চালিয়েছেন। তাতে তাঁর সঙ্গ দিয়েছে পোল ডান্স।
৩৯ বছরের স্মাইলি সংবাদমাধ্যমের কাছে এক বার বলেছিলেন, ‘‘আজও বহু রাতে চোখের জলে ভিজে ঘুমিয়ে পড়ি। তবে পোল ডান্সের কোনও শিক্ষার্থী যখন জানায় যে আমার নাচের প্রশিক্ষণে তার মনোবল বেড়ে গিয়েছে, তখন নতুন করে ভরসা পাই।’’