শ্রদ্ধা হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্ত প্রেমিক আফতাব আমিন পুনাওয়ালার নার্কো এবং পলিগ্রাফ পরীক্ষার অনুমতি চেয়েছিল দিল্লি পুলিশ। আদালতের নির্দেশে ইতিমধ্যেই আফতাবের পলিগ্রাফ পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু কী এই পলিগ্রাফ পরীক্ষা? কী ভাবেই বা এই পরীক্ষা তদন্তে সাহায্য করে?
পলিগ্রাফ পরীক্ষার অপর নাম ‘লাই ডিটেক্টর’ পরীক্ষা অর্থাৎ অভিযুক্ত মিথ্যা বলছেন কি না, তা যাচাইয়ের পরীক্ষা।
একটি পলিগ্রাফ পরীক্ষা সাধারণত জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে করা হয়।
‘কার্ডিও-কাফ’ বা সংবেদনশীল ইলেক্ট্রোডের মতো কয়েকটি যন্ত্র তারের মাধ্যমে অভিযুক্তের শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। সেই সময় অভিযুক্তের রক্তচাপ, নাড়ি, রক্তপ্রবাহ ইত্যাদি স্বাভাবিক আছে কি না, তা মেপে নেওয়া হয়।
অভিযুক্তের শারীরিক প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক থাকলে ওই অভিযুক্তকে তদন্ত সংক্রান্ত একাধিক প্রশ্ন করেন তদন্তকারীরা। অভিযুক্ত কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় তার হৃদ্স্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাসে পরিবর্তন বা রক্তচাপ বাড়ছে-কমছে কি না, একটি বৈদ্যুতিন স্ক্রিনের মাধ্যমে তার উপর নজর রাখেন চিকিৎসক এবং ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। এমনকি, উত্তর দেওয়ার সময় অভিযুক্তের ঘাম হচ্ছে কি না, তার উপরও বিশেষ নজর রাখেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিটি প্রশ্ন শোনার পর এবং উত্তর দেওয়ার সময় অভিযুক্তের শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়াগুলি একটি গ্রাফ বা লেখচিত্রের মধ্যে ধরা পড়ে।
পরে এই লেখচিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা হয় যে, অভিযুক্ত মিথ্যা কথা বলছেন না সত্যি কথা বলছেন।
উনিশ শতকে ইতালির অপরাধ বিশেষজ্ঞ সিজ়ার লোমব্রোসো প্রথম পলিগ্রাফ পরীক্ষা করেন। তিনি অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁদের রক্তচাপের পরিবর্তন মাপার জন্য একটি মেশিন ব্যবহার করেন।
পরবর্তী কালে আমেরিকার মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম মার্স্ট্রন ১৯১৪ সালে এবং ক্যালিফোর্নিয়ার পুলিশ অফিসার জন লারসন ১৯২১ সালে এই নিয়ে আরও পরীক্ষা শুরু করেছিলেন।
পলিগ্রাফ পরীক্ষা বা নার্কো পরীক্ষা কোনওটাই বৈজ্ঞানিক ভাবে একশো শতাংশ সঠিক ফলাফল দেয় বলে প্রমাণিত হয়নি।
চিকিৎসকদের মধ্যেও এই পরীক্ষার যৌক্তিকতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এই পরীক্ষা নিয়ে একাধিক বার বিতর্কও তৈরি হয়েছে (যেমন, আরুষি তলোয়ার মামলাতে হয়েছিল)।
সম্প্রতি ভারতে তদন্তকারী সংস্থাগুলির কাছে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের একটি বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে পলিগ্রাফ এবং নার্কো পরীক্ষা। অনেকেই এই পরীক্ষাগুলিকে সত্যি কথা বার করার জন্য পুলিশি অত্যাচারের বিকল্প বলে মনে করেন।
পলিগ্রাফ পরীক্ষার ফলাফলকে কোনও ভাবেই ‘স্বীকারোক্তি’ হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। তবে পরীক্ষা চলাকালীন নতুন কোনও তথ্য তদন্তকারীদের হাতে এলে তা তাঁরা আদালতে প্রমাণ হিসাবে পেশ করতে পারেন।
এই পরীক্ষা করার জন্য অভিযুক্তের অনুমতি থাকাও আবশ্যিক।
ছ’মাস আগে ১৮ মে দিল্লির মেহরৌলীতে একত্রবাসে থাকা প্রেমিকা শ্রদ্ধা ওয়ালকরকে খুনের অভিযোগ রয়েছে প্রেমিক আফতাব আমিন পুনাওয়ালার বিরুদ্ধে। শ্রদ্ধার বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে দিল্লি পুলিশ ১২ নভেম্বর শনিবার আফতাবকে গ্রেফতার করে। চলছে তদন্ত। তদন্তে নেমে একাধিক প্রমাণও উঠে এসেছে পুলিশের হাতে।
তদন্ত চলাকালীন আদালতে আফতাবের উপর নার্কো এবং পলিগ্রাফ পরীক্ষা করার অনুমতি চান তদন্তকারীরা। মনে করা হচ্ছে, পুলিশের হাতে এখনও পর্যন্ত আফতাবের বিরুদ্ধে কোনও পাকা প্রমাণ উঠে আসেনি। আর সেই কারণেই এই পরীক্ষা।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে আফতাবের পলিগ্রাফ পরীক্ষা। বৃহস্পতিবার প্রায় আট ঘণ্টা ধরে আফতাবের পলিগ্রাফ পরীক্ষা চলে বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
দিল্লির রোহিণীর ‘ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’ (এফএসএল)-এ দুপুর ১২টা থেকে প্রায় আট ঘণ্টা ধরে আফতাবের পলিগ্রাফ পরীক্ষার দ্বিতীয় পর্ব চলে। এই পরীক্ষা চলাকালীন তাঁকে প্রায় চল্লিশটি প্রশ্ন করা হয় বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
সূত্রের খবর, পুনাওয়ালা জ্বরে ভুগছেন। আর সেই কারণে বুধবার তাঁর পলিগ্রাফ পরীক্ষা করা যায়নি। বৃহস্পতিবারের পলিগ্রাফ পরীক্ষার সময় তিনি সহযোগিতা করলেও অতিরিক্ত হাঁচির কারণে কিছু রেকর্ডিং পরিষ্কার হয়নি। শুক্রবার তাঁকে আবারও পরীক্ষার জন্য ডাকা হতে পারে বলে এফএসএল-এর ডিরেক্টর দীপা বর্মা জানিয়েছেন।
এফএসএল সূত্রে খবর, পলিগ্রাফ পরীক্ষায় প্রশ্নোত্তর পর্ব চলাকালীন, আফতাবকে বিভিন্ন বিষয়ে বিশদে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি শ্রদ্ধাকে কেন খুন করেন এবং খুন করার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত কি না, সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়।
শ্রদ্ধার দেহ তিনি কী ভাবে টুকরো টুকরো করেছিলেন, সেই বিষয়েও করা হয় জিজ্ঞাসাবাদ। খুব শীঘ্রই পলিগ্রাফ পরীক্ষার রিপোর্ট জানা যাবে বলেও এফএসএল সূত্রে খবর।
কয়েক দিনের মধ্যে আফতাবের নার্কো পরীক্ষা শুরু হবে বলেও এফএসএল সূত্রে জানা গিয়েছে।