২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল। দু’বছর ধরে লন্ডনে পর পর ৪টি খুন হয়। এই খুনের তদন্ত করতে নেমে পুলিশের হাতে আসে ভয়াবহ তথ্য। চারটি মৃতদেহেই বিপুল পরিমাণ মাদকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে তাঁদের প্রত্যেককেই ধর্ষণ করা হয়। এর পিছনে কোনও ‘সিরিয়াল কিলার’-এর হাত রয়েছে বলে অনুমান করে পুলিশ। শেষ পর্যন্ত খুনিকে শনাক্তও করে ফেলে তারা।
খুনির নাম স্টিফেন পোর্ট। সমকামী ছিলেন তিনি। পুলিশের দাবি, স্টিফেন ডেটিং অ্যাপ থেকে আলাপ করেছিলেন চার জনের সঙ্গে। অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাবেন বলে তাঁদের নিজের ফ্ল্যাটে ডাকেন এবং ধর্ষণ করার পর খুন করেন।
১৯৭৫ সালে এসেক্সে জন্ম স্টিফেনের। ১ বছর বয়সে পরিবার-সহ পূর্ব লন্ডনের ডাগেনহামে চলে আসেন তিনি। স্বভাবে শান্ত প্রকৃতির ছিলেন স্টিফেন। ছোট থেকেই পুতুলের সঙ্গে খেলা করতে পছন্দ করতেন তিনি। তা নিয়ে স্কুলের সহপাঠীরা স্টিফেনকে হেনস্থাও করত।
১৬ বছর বয়সে স্কুলের গণ্ডি পার করার পর আর্ট কলেজে ভর্তি হন স্টিফেন। কিন্তু পড়াশোনার খরচ সামলাতে না পারায় স্টিফেনের বাবা-মা তাঁকে আর্ট কলেজ থেকে ছাড়িয়ে দেন। পরে দু’বছরের জন্য পাচক হওয়ার প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় এক জনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান স্টিফেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গী সম্পর্কে ইতি টানেন। স্টিফেনের আচরণ অদ্ভুত এবং শিশুসুলভ বলে সম্পর্ক বজায় রাখতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি।
২০ বছর বয়সে স্টিফেন বুঝতে পারেন, নারী নয়, বরং পুরুষদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন তিনি। ইংল্যান্ডেই পাচকের কাজ করতেন তিনি। ৩০ বছরের গণ্ডি পেরোনোর পর লন্ডনের বার্কিংয়ে একটি ফ্ল্যাটে একা থাকতে শুরু করেন। তার পরেই শুরু হয় এক ভয়ানক অধ্যায়।
বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খোলেন স্টিফেন। প্রথমেই তাঁর আলাপ হয় এক দেহব্যবসায়ীর সঙ্গে। ২০১৪ সালের ১৭ জুনের ঘটনা। ২৩ বছর বয়সি অ্যান্টনি ওয়ালগেট ফ্যাশন নিয়ে পড়াশোনা করার পাশাপাশি দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পুলিশের দাবি, ডেটিং অ্যাপে অ্যান্টনির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর তাঁকে নিজের ফ্ল্যাটে ডাকেন স্টিফেন। পানীয়ের মধ্যে মাদক মিশিয়ে ধর্ষণ করেন অ্যান্টনিকে।
অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে মারা যান অ্যান্টনি। তার পর অ্যান্টনির দেহ ঘর থেকে বার করে নিজের ফ্ল্যাটের পিছনে ফাঁকা জায়গায় ফেলে দেন স্টিফেন। নিজে থেকেই পুলিশকে ফোন করেন তিনি। অ্যান্টনির দেহ রাস্তায় ও ভাবে পড়ে থাকতে দেখে নাকি ভয় পেয়ে পুলিশকে ফোন করেন তিনি।
তদন্তের পর পুলিশের হাতে ধরা পড়েন স্টিফেন। আট মাস হেফাজতেও ছিলেন তিনি। পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এর পর ২২ বছর বয়সি গ্যাব্রিয়েল কোভারির সঙ্গে একত্রবাস শুরু করেন তিনি। পুলিশের দাবি, মাদক মিশিয়ে, ধর্ষণ করে ওই একই পদ্ধতিতে গ্যাব্রিয়েলকে খুন করেন স্টিফেন।
এর পর ২১ বছর বয়সি ড্যানিয়েল হুইটওয়ার্থকেও খুন করেন স্টিফেন। খুন করে কবরখানার ভিতর ড্যানিয়েলের দেহ ফেলে দেন তিনি। মৃতদেহের পাশে একটি সুইসাইড নোট ফেলে রাখেন যাতে লেখা ছিল, ‘‘গ্যাব্রিয়েলকে খুন করার জন্য আমি দায়ী। ওর মৃ্ত্যুর দায় আমায় কুরে কুরে খাচ্ছিল। তাই আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম।’’
ড্যানিয়েলকে খুন করার পর ২৫ বছর বয়সি জ্যাক টেলরকে খুন করেন স্টিফেন। পেশায় ট্রাকচালক ছিলেন জ্যাক। শুধু তা-ই নয়, পুলিশের দাবি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এই চার জন ছাড়াও আরও অনেককে ধর্ষণ করেছেন তিনি। বিষ প্রয়োগ করে খুনও করেছেন অনেককে। তবে সব ক’টি খুনের প্রমাণ মেলেনি।
২০১৬ সালে পুলিশ আবার গ্রেফতার করে স্টিফেনকে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁকে। পুলিশ সূত্রের খবর, নিজের ভুয়ো পরিচয় তৈরি করে লোকজনের সঙ্গে আলাপ করতেন স্টিফেন।
স্টিফেন যাঁদের সঙ্গে ডেট করতেন, তাঁদের জানাতেন, তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। এমনকি, নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন বলেও জানান।
স্টিফেনকে যিনি মাদক বিক্রি করতেন, তাঁকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। ৩১ বছরের জন্য কারাদণ্ডের সাজা হয় তাঁর।
কানাঘুষো শোনা যায়, বার্কিংয়ের যে ফ্ল্যাটে তিনি চার জনকে খুন করেছিলেন, সেই ফ্ল্যাটটি চড়া দামে বিক্রি করে দেন স্টিফেন। ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা দিয়েই নাকি তিনি জেলের ভিতর ভিডিয়ো গেমস কিনে খেলেন বলে অনেকের দাবি।