Sergei Krikalev

কয়েক হাজার বার পৃথিবীকে পাক দেন, কমে যায় বয়স, মহাকাশ থেকে ফিরে দেখেন গায়েব নিজের দেশই!

সেরগেই সব মিলিয়ে ছ’বার মহাকাশ অভিযানে বেরিয়েছেন। মহাকাশে থেকেছেন মোট ৮০৩ দিন ৯ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট। তবে সেরগেইয়ের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে আরও একটি কারণে। যা তাঁকে অন্য সমস্ত মহাকাশচারীদের থেকে আলাদা করে দেবে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৪ ১২:১৩
Share:
০১ ২৪
Sergei Krikalev was an Astronaut who had to spend 311 days in space for only one mission and lost his country during that stay

মহাকাশে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল বিশেষ কাজের দায়িত্ব দিয়ে। সেই দায়িত্ব সফল ভাবে পালন করার পরও তাঁর আর দেশে ফেরা হয়নি। কারণ মহাকাশে থাকাকালীন তাঁর দেশটাই মুছে গিয়েছিল পৃথিবীর মানচিত্র থেকে।

০২ ২৪
Sergei Krikalev was an Astronaut who had to spend 311 days in space for only one mission and lost his country during that stay

নাম সেরগেই ক্রিকালেভ। সাবেক সোভিয়েতের এই মহাকাশচারী বিশ্বের প্রথম চার মহাকাশচারীদের এক জন, যাঁরা সবচেয়ে বেশি সময় ধরে মহাকাশে থেকেছেন।

Advertisement
০৩ ২৪
Sergei Krikalev was an Astronaut who had to spend 311 days in space for only one mission and lost his country during that stay

সেরগেই সব মিলিয়ে ছ’বার মহাকাশ অভিযানে গিয়েছেন। মহাকাশে থেকেছেন মোট ৮০৩ দিন ৯ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট। তিনি ছাড়া এমন রেকর্ড রয়েছে বিশ্বের আর মাত্র তিন মহাকাশচারীর। তবে সেরগেইয়ের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে আরও একটি কারণে। যা তাঁকে অন্য সমস্ত মহাকাশচারীদের থেকে আলাদা করে দেবে।

০৪ ২৪

সেরগেইয়ের শুধুমাত্র একটি অভিযানই দীর্ঘায়িত হয়েছিল প্রায় এক বছর। টানা ৩১১ দিন মহাকাশে থেকেছেন তিনি। অথচ যে কাজ তাঁকে দেওয়া হয়েছিল, তা শেষ করে মাস চারেকের মধ্যেই ফিরে আসার কথা ছিল তাঁর।

০৫ ২৪

১৯৯১ সালের ১৯ মে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন সেরগেই। তাঁকে এবং আরও দুই মহাকাশচারীকে নিয়ে মহাকাশে রওনা হয় সাবেক সোভিয়েতের মহাকাশযান সয়ুজ-টিএম। অভিযানের নাম ছিল সয়ুজ-টিএম ১২। লক্ষ্য ছিল, তিন মহাকাশচারীকে মহাকাশ স্টেশন মির (এমআইআর)-এ পৌঁছে দেওয়া। যাতে তাঁরা সেখানে থেকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন।

০৬ ২৪

মির ছিল সোভিয়েত পরিচালিত বিশ্বের প্রথম আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন মহাকাশ স্টেশন। যেখানে থেকে মহাকাশচারীরা গবেষণা সংক্রান্ত কাজ করতে পারতেন। সেখানেই কিছু প্রযুক্তিগত দায়িত্ব পালনের জন্য পাঠানো হয়েছিল সেরগেইকে। অভিযানে তিনি অংশ নিয়েছিলেন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। মহাকাশে সেটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় অভিযান।

০৭ ২৪

১৪৪ দিনের এই অভিযান শেষ হয় ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর। কিন্তু তিন মহাকাশচারীর দু’জন ফিরে এলেও সেরগেই ফিরতে পারেননি। তাঁকে বলা হয়, পরবর্তী অভিযানের জন্য মিরেই থেকে যেতে।

০৮ ২৪

পরবর্তী অভিযানের নাম ছিল সয়ুজ-টিএম১৩। এই অভিযানে কোনও ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন না। সম্ভবত সেরগেইয়ের ভরসাতেই এক জন কম্যান্ডার আর দুই গবেষককে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মহাকাশ স্টেশনে। তবে মিরে তাঁরা বেশি দিন থাকতে পারেননি।

০৯ ২৪

সেই সময়ে সোভিয়েতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ১৯৯১ সালের ৪ অক্টোবর মিরে পৌঁছয় সয়ুজ-টিএম১৩। দুই মহাকাশচারীকে পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয় তার ছ’দিনের মধ্যেই। তার পরই বদলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস।

১০ ২৪

২৬ অক্টাবর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে নিজেদের মুক্ত বলে ঘোষণা করে কাজাখস্তান। এতে বিপদ বাড়ে মহাকাশ স্টেশনে থাকা সেরগেইয়ের। কারণ ভৌগোলিক হিসাবে তিনি কাজাখস্তানের বাসিন্দা। কিন্তু যে সরকারের হয়ে তিনি মহাকাশ অভিযান চালাচ্ছেন সেই সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের।

১১ ২৪

সেরগেই কী ভাবে দেশে ফিরবেন, ফিরলে কোন দেশে ফিরবেন তা নিয়ে টালবাহানা চলতে থাকে। তার উপর সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রটিও ছিল কাজাখস্তানের সীমানার মধ্যেই। ফলে জটিলতা আরও বাড়ে।

১২ ২৪

এ দিকে সোভিয়েত দেশটার ভিতও নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে তত দিনে। সেরগেই যদিও সে কথা জানতেন না। মহাকাশে বসে এত খবর পাওয়াও সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। আচমকাই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি ক্রমাগত চেষ্টা করতে থাকেন পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের।

১৩ ২৪

মিরে তখন সেরগেইয়ের সঙ্গে ছিলেন আরও এক জন। তিনি সয়ুজ-টিএম ১৩-এর কম্যান্ডার আলেক্সান্ডার ভলকভ। কিন্তু সেরগেই মহাকাশে রয়েছেন আরও অন্তত পাঁচ মাস আগে থেকে। পৃথিবীকে অন্তত ৩০০০ পাক ঘুরে ফেলেছেন তিনি। মহাকাশ সফরের প্রভাব পড়েছে শরীরে।

১৪ ২৪

দু’জনেই অপেক্ষা করে চলেছিলেন পরবর্তী অভিযানে আসা মহাকাশচারীদের জন্য। যাতে তাঁদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তাঁরা ফিরতে পারেন। আর এ দিকে, সোভিয়েতে তখন হুলস্থুল চলছে। ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বরে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। জন্ম হয় একাধিক দেশের। একা ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নাগরিক’ হিসাবে মহাকাশে থেকে যান সেরগেই।

১৫ ২৪

মাসের পর মাস কেটে যায়। দেশের অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে মহাকাশচারীদের কথা প্রায় ভুলেই যান সকলে। মনে থাকে শুধু সেরগেইয়ের পরিবারের। কিন্তু সরকারই যেখানে পাকাপোক্ত নয়, সেখানে মহাকাশচারীদের ঘরে ফেরানোর কথা কার কাছে বলবেন, তা বুঝতে পারছিলেন না তাঁরাও।

১৬ ২৪

মহাকাশে সেরগেইদের কাছে এত খবর ছিল না। তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন ফেরার। মহাকাশচারী হওয়ার আগে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন সেরগেই। বেতার তরঙ্গ নিয়ে গবেষণাও করেছেন। মহাকাশ স্টেশন থেকে একটি প্যাকেট রেডিয়োর সাহায্যে তিনি নিয়মিত সঙ্কেত পাঠাতেন পৃথিবীতে। তাঁদের উদ্ধারের কথা বলতেন। সাহায্য চাইতেন।

১৭ ২৪

অবশেষে সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়। বেশ কয়েক মাস পর তাঁর বেতারের সঙ্কেত এসে পৌঁছয় এক অ্যামেচার মহিলা রেডিয়ো অপারেটরের কাছে।

১৮ ২৪

মিরে থাকাকালীন শেষ কয়েক মাস সেই অপারেটরের সঙ্গে নিয়মিত দিনে এক বার করে যোগাযোগ করতেন সেরগেই, কথা বলতেন ব্যক্তিগত বিষয় থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি— সব কিছু নিয়ে। তার সঙ্গে চলতে থাকে দেশে ফেরার অপেক্ষাও।

১৯ ২৪

অবশেষে ১৯৯২ সালের মার্চে সেরগেইদের কথা মনে পড়ে প্রশাসনের। টানা ৩১১ দিন পর পৃথিবীতে ফেরেন সেরগেই। কিন্তু তত দিনে তাঁর শরীরের উপর প্রভাব ফেলেছে পরিস্থিতি। মাধ্যাকর্ষণহীন মহাকাশ স্টেশনে টানা ১০ মাস থাকা, উচ্চ ভরবেগে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে নিদেনপক্ষে ৫০০০ পাক ঘোরা— সব কিছু শারীরিক এবং মানসিক প্রভাব ফেলেছে তাঁর উপর। দুর্বল হয়েছে পেশি। দুর্বল হয়েছে হাড়ও।

২০ ২৪

মানসিক ভাবেও বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলেন সেরগেই। তবে একই সঙ্গে দীর্ঘ দিন মহাকাশে থাকার জন্য সেরগেইয়ের বয়সের চাকা পিছিয়েও গিয়েছিল কয়েক মুহূর্ত। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল, সমসাময়িকদের থেকে ঠিক ০.০২ সেকেন্ড পিছিয়েছে তাঁর বয়সের চাকা।

২১ ২৪

তবে মহাকাশের ওই অভিজ্ঞতার পরও সেরগেইকে থামিয়ে রাখা যায়নি। দীর্ঘ দিন নানা রকম শারীরিক এবং মানসিক চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন তিনি। ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে ফিরেছিলেন মহাকাশ থেকে। সেই বছর অক্টোবরেই নাসা ঘোষণা করে এক জন অভিজ্ঞ মহাকাশচারীকে মহাকাশে পাঠাতে চলেছে তাঁরা। তিনি সেরগেই।

২২ ২৪

১৯৯৩ সালের এপ্রিল থেকে নতুন করে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। সেপ্টেম্বরেই পাড়ি দেন মহাকাশে। তার পর আরও তিনটি মহাকাশ অভিযানে অংশ নিয়েছেন। নাসার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পদার্পণ করা প্রথম দুই মহাকাশচারীর এক জনও ছিলেন তিনিই।

২৩ ২৪

পরে সেরগেইকে রাশিয়ার ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশ কেন্দ্রের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নায়কের মর্যাদাও পান সেরগেই। পরে তাঁকে নিয়ে তৈরি হয় তথ্যচিত্র, বাণিজ্যিক সিনেমাও। অস্কারের মঞ্চে মনোনয়ন পেয়েছিল তাঁর কাহিনি নিয়ে তৈরি সেই ছবি।

২৪ ২৪

আসলে সেরগেই দেখিয়ে দিয়েছেন হাল না ছাড়লে আর মাথা ঠান্ডা রাখলে অনেক জটিল যুদ্ধও জয় করা সম্ভব। বর্তমানে এই সেরগেই দেশের হয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজে নেমেছেন। জানুয়ারি মাসেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়েছেন, তাঁর দেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত মেলবন্ধনের দূত হবেন সেরগেই। ৬৫ বছরের অভিজ্ঞ মহাকাশচারী আপাতত তাঁর নতুন দায়িত্ব নিয়েই ব্যস্ত।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement