সাল ১৯২৩। লন্ডনে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ সার্জেন-এ দাঁড়িয়ে একের পর এক ছবি দেখাচ্ছিলেন সার্জ ভোরোনফ। সঙ্গে শোনাচ্ছিলেন অবিশ্বাস্য সব গল্প। তাঁর কথা শুনে বিস্ময়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন সভায় উপস্থিত শয়ে শয়ে চিকিৎসক।
বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অন্তত ৭০০ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হাজির হয়েছিলেন লন্ডনের ওই সভায়। তাঁদের সামনেই নিজের আবিষ্কার এবং কীর্তির নজির তুলে ধরেছিলেন ভোরোনফ।
ফরাসি চিকিৎসক ভোরোনফের জন্ম রাশিয়ায়। চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে তিনি নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন পরীক্ষানিরীক্ষায়। যার কিছু সফল হয়েছে, কিছু ব্যর্থ।
মূলত মানবদেহে গ্রন্থি প্রতিস্থাপনের জন্য শিরোনামে উঠে এসেছিলেন ভোরোনফ। তাঁর দাবি ছিল, এই ধরনের প্রতিস্থাপনের পর মানুষের বয়স কমে যায় হু হু করে। গ্রন্থি প্রতিস্থাপনে নিশ্চিত সুফলের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন এই ফরাসি চিকিৎসক।
লন্ডনের সভায় উপস্থিত বিশ্বের তাবড় চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞকে ভোরোনফ তাঁর প্রতিস্থাপনের নমুনার ছবি দেখিয়ে চমকে দিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে অস্ত্রোপচারের পর বয়স্কদের চেহারা এবং অন্যান্য আনুসাঙ্গিক বিষয়ে চোখে পড়ার মতো বদল এসেছে।
মানুষের দেহে বাঁদরের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন করে দেখিয়েছিলেন ভোরোনফ। সেটাই ছিল তাঁর বিশেষত্ব। এই অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপনের পরেই যে কোনও ব্যক্তির বয়স কমে যায় বলে দাবি করেছিলেন তিনি।
১৮৬৬ সালে রাশিয়ার এক ইহুদি পরিবারে জন্ম ভোরোনফের। ১৮ বছর বয়সে ডাক্তারি পড়তে তিনি প্যারিস চলে যান। সেখানে স্বনামধন্য ফরাসি শল্যচিকিৎসক অ্যালেক্সিস ক্যারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেলজয়ী ক্যারলের কাছ থেকে শল্যচিকিৎসার খুঁটিনাটি শেখেন ভোরোনফ। পশুর দেহ থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করার বিষয়ে এই সময়েই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন ভোরোনফ।
১৮৮৯ সালে ভোরোনফ জনপ্রিয় শরীরতত্ত্ববিদ চার্লস-এডুয়ার্ড ব্রাউন সেকুয়ার্ডের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। মনের মতো সঙ্গী পেয়েছিলেন ভোরোনফ। কারণ সেকুয়ার্ডও পশুর হরমোনের মাধ্যমে মানুষের বয়স কমানোর পন্থা আবিষ্কারে আগ্রহী ছিলেন। এমনকি নিজের দেহে পশুর হরমোন ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রবেশও করিয়েছিলেন তিনি। তবে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি।
১৮৯৬ সালে ফ্রান্স ছেড়ে মিশর চলে আসেন ভোরোনফ। সেখানে তিনি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সংস্পর্শে থেকে দীর্ঘ সময় তাঁদের পর্যবেক্ষণ করেন। অণ্ডকোষ না থাকায় তাঁদের শরীরে কী কী বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, কাছ থেকে দেখে আসেন ভোরোনফ।
মিশরের হাসপাতালে ১৪ বছর নানা পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষানিরীক্ষার পর ১৯১০ সালে ফ্রান্সে ফিরে আসেন ভোরোনফ। পশুর অঙ্গ ইচ্ছুক মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা শুরু হয় এই সময়েই।
১৯১৩ সালে এক ফরাসি যুবকের দেহে তিনি শিম্পাঞ্জির থাইরয়েড গ্রন্থি প্রতিস্থাপিত করেছিলেন। ভোরোনফের দাবি, তাঁর চিকিৎসার পরে ওই যুবকের দেহে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু পরিবর্তন এসেছিল। যা থেকে স্পষ্ট, বয়স কমে গিয়েছে যুবকের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসক হিসাবে ভোরোনফের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে আহত ফরাসি সেনাদের দেহে তিনি শিম্পাঞ্জির হাড়ও প্রতিস্থাপন করেন একাধিক বার।
বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঁদরের অণ্ডকোষ মানুষের দেহে বসানো এবং তার সম্ভাব্য ফলাফলের কথা চিন্তা করেন ভোরোনফ। তিনি মনে করতেন, মানবদেহে অণ্ডকোষের ভূমিকা কেবল যৌনক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়।
মানুষের শরীরে হাড়, পেশি, স্নায়ু এবং মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াতেও অণ্ডকোষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করতেন ভোরোনফ। ১৯১৭ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত তিনি পশুর দেহে একাধিক অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপনের পরীক্ষা করে দেখেন।
১৯২০ সালে প্রথম মানুষের দেহে অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন করেন ভোরোনফ। ৭৪ বছর বয়সি এক প্রায় অথর্ব বৃদ্ধের দেহে প্রতিস্থাপিত হয় বাঁদরের অণ্ডকোষ।
চিকিৎসক দাবি করেন, এই প্রতিস্থাপনের পর বৃদ্ধ তাঁর হারানো স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। তাঁর শরীরে ফিরে এসেছিল যৌবনের বল। সেরে গিয়েছিল নানা বার্ধক্যজনিত রোগব্যধি।
১৯২৩ সালে লন্ডনের সভার পর ভোরোনফের চিকিৎসা পদ্ধতি এবং অস্ত্রোপচারের চমক ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। দেশ-বিদেশের বহু মানুষ বাঁদরের অণ্ডকোষ নিজের দেহে বসিয়ে বয়স কমানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এই সময়ে বহু চিকিৎসক ভোরোনফের চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করে সাফল্য পেয়েছেন বলে দাবি করেন। আমেরিকা, ইটালি, রাশিয়া, ব্রাজিল, চিলি এমনকি ভারতেও ব্যবহৃত হয় এই পদ্ধতি।
১৯২০ থেকে ১৯৪০— এই ২০ বছরে অন্তত ২ হাজার মানুষের দেহে বাঁদরের অণ্ডকোষ বসানো হয়েছিল। যার মধ্যে শুধুমাত্র ফ্রান্সের বাসিন্দাই ছিলেন ৫০০ জন।
বাড়তে থাকা চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে ভোরোনফ একটি বাঁদরের খামার চালু করেছিলেন। বাঁদরের চাষ করা হত সেখানে।
শুধু অণ্ডকোষেই থেমে থাকেননি ভোরোনফ। স্ত্রী দেহে বাঁদরের জরায়ুও তিনি প্রতিস্থাপিত করেছিলেন। ৪৮ বছরের এক ব্রাজিলীয় মহিলা সেই অস্ত্রোপচারের পর ৩৫ বছর বয়সে নেমে এসেছিলেন বলে দাবি করেন তিনি। ৪ মাসের মধ্যে অন্তত ১৬ কিলোগ্রাম ওজন কমে গিয়েছিল ওই মহিলার। এখানেই শেষ নয়, বাঁদরের দেহে মানুষের অঙ্গ বসানোর চেষ্টাও করেছিলেন ভোরোনফ। তবে তাঁর সেই পরীক্ষা সফল হয়নি।
ভোরোনফের কেরিয়ার যখন মধ্যগগনে, তখন আচমকাই থেমে যায় তাঁর দৌড়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিজ্ঞানীদের একাংশ দাবি করেন, ভোরোনফের কারসাজিতে গলদ রয়েছে। তাঁর প্রস্তাবিত বেশির ভাগ প্রক্রিয়াই ভিত্তিহীন, দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি, এই চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু ত্রুটিও প্রকাশ্যে আসে।
বিজ্ঞানীদের একাংশ পরে দাবি করেন, এডসের মতো যৌনরোগ সৃষ্টির নেপথ্যেও দায়ী ভোরোনফের নানা পরীক্ষানিরীক্ষা।
চিকিৎসা পদ্ধতির অজস্র ত্রুটির দায় মাথায় নিয়ে ১৯৫১ সালে পরলোকে পাড়ি দেন ভোরোনফ। তবে মানুষের মনে বয়স কমিয়ে দেওয়ার যে আশা তিনি জাগিয়েছিলেন, তা এখনও পর্যন্ত পূরণ করতে পারেননি অন্য কেউ।