দু’দিনের রাশিয়া সফরে গিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০১৯ সালের পর পাঁচ বছরে এই প্রথম তিনি রাশিয়া গেলেন। মোদীর রাশিয়া সফরের দিকে নজর রয়েছে পশ্চিমি দুনিয়ার।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে একজোট হয়েছিল। বহু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশের উপর। তবে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কে ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচ লাগেনি।
ভারত বরাবরই রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক কখনও খারাপ হয়নি ভারতের। বরং আমেরিকা এবং রাশিয়ার মতো বিশ্বের দুই তাবড় শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলেছে নয়াদিল্লি।
পাঁচ বছর পর মোদীর রাশিয়া সফরের মাঝে নতুন করে চর্চায় উঠে এসেছে এই দুই দেশের সম্পর্ক। ইতিহাস ঘাঁটলে ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে খুব বেশি সংঘাতের উল্লেখ মেলে না। ভারতে দীর্ঘ ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন কিংবা তার আগে-পরে রাশিয়ার উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি সংঘাতের ইতিহাসও যে রয়েছে, যা অনেকে জানেন না। সংঘাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় তা ইতিহাসের পাতাতেও তেমন গুরুত্ব পায়নি কখনও।
অতীতে অন্তত চার বার ভারত দখলের চেষ্টা করেছিল রাশিয়া। সমুদ্র পেরিয়ে, স্থলভাগ দিয়ে ভারতে ঢুকে দিল্লি আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। চার বারই অবশ্য পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল।
ভারত আক্রমণের চেষ্টা করলেও রাশিয়ার ‘শত্রু’ কিন্তু ভারত ছিল না। তারা সে সময়ে শত্রু হিসাবে দেখেছিল ব্রিটেনকে। ভারত থেকে ব্রিটিশরাজ উৎখাত করতে চেয়েছিল রাশিয়া।
তবে ভারতে এসে রাশিয়া ব্রিটিশদের মতো উপনিবেশ স্থাপন করতে চেয়েছিল, না কি ভারতকে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে চেয়েছিল, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
অষ্টাদশ শতকের শেষ এবং ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে রাশিয়ার নজর পড়েছিল ভারত এবং ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে। সে সময়ে রাশিয়ার সিংহাসনে ছিলেন জ়ার প্রথম পল।
ভারতে ব্রিটিশদের ভিত ক্রমশ মজবুত হচ্ছে, উপলব্ধি করেছিলেন পল। এতে যে আদতে রাশিয়ার ক্ষতি, তা-ও তিনি অনুমান করেছিলেন। ফলে ব্রিটিশ ভারতে আক্রমণ চালিয়ে ভারত থেকে তাদের সরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি।
জ়ার প্রথম পল ভারত আক্রমণের প্রস্তাব নিয়ে ফ্রান্সের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সে সময়ে ফ্রান্সের শাসক ছিলেন নেপোলিয়ান। রাশিয়ার প্রস্তাব ছিল, সমুদ্র পেরিয়ে দুই দেশের সেনা পারস্যে (বর্তমান ইরান) পৌঁছবে। সেখান থেকে আফগানিস্তান হয়ে ভারতে ঢুকবে এবং আক্রমণ চালাবে।
নেপোলিয়ান প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় রাশিয়ার ভারত আক্রমণের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ভারত আক্রমণ করে ফ্রান্সের কোনও লাভ হতে পারে বলে তিনি মনে করেননি সে সময়ে।
নেপোলিয়ান প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ার পরেও হাল ছাড়েননি পল। তিনি ২২ হাজার সেনা নিয়ে একাই ভারত আক্রমণ করবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে গিয়ে তাঁর অনেক সৈন্যক্ষয় হয়েছিল। এর মাঝে রাশিয়ায় জ়ার প্রথম পলকে হত্যাও করা হয়।
প্রথম পলের মৃত্যুর পর রাশিয়ার সম্রাট হন প্রথম আলেকজ়ান্ডার। তাঁর মাথাতেও ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা এসেছিল। যা নিয়ে তিনি আবার ফ্রান্স সম্রাট নেপোলিয়ানের দ্বারস্থ হন।
নেপোলিয়ান এবং প্রথম আলেকজ়ান্ডারের মধ্যে টিলসিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। শর্ত অনুযায়ী ফ্রান্স এবং রাশিয়ার সেনা ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনাও দিয়েছিল। কিন্তু এ বার বাধা আসে অন্য দিক থেকে।
জ়ার প্রথম পল যখন ব্রিটিশ ভারত আক্রমণের ছক কষেছিলেন, সে সময়েই ব্রিটেন সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। তারা পারস্যের সঙ্গে চুক্তি করে, ফ্রান্স বা রাশিয়া ভারতে আসতে চাইলে পারস্যের ভূমি ব্যবহার করতে পারবে না।
স্থলপথে ফ্রান্সের ভারতে প্রবেশের একটাই সহজ পথ ছিল— পারস্য হয়ে আসা। তারা দরজা বন্ধ করে দিলে রাশিয়া এবং ফ্রান্সের সেনাকে আবার পিছিয়ে যেতে হয়। আবার ভেস্তে যায় ভারত দখলের পরিকল্পনা।
তৃতীয় বার রাশিয়া থেকে ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা হয় আরও ৪০ বছর পর। এর মাঝে ফ্রান্স এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। নেপোলিয়ান ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া আক্রমণ করেন। জ্বালিয়ে দেন মস্কো শহর।
ঊনবিংশ শতকের পঞ্চাশের দশকে ব্রিটিশ ভারত আক্রমণের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন রাশিয়ান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আলেকজ়ান্ডার দুহামেল। জ়ার প্রথম নিকোলাসকে তিনি জানান, ভারত আক্রমণের পথে পারস্য নামক প্রতিবন্ধকতাটিকে তিনি সামলে নিতে পারবেন। তারা রাশিয়ান সেনাকে আর বাধা দেবে না।
কিন্তু এই সময়ে পারস্যের প্রতিবেশী অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ বেধে যায়। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে প্রচুর সংখ্যক রাশিয়ান সেনা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভারত আক্রমণ করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আঘাত হানা আর হয়ে ওঠে না রাশিয়ার।
চতুর্থ বার রাশিয়া ভারত দখলের চেষ্টা করেছিল সেনাপ্রধান স্টিফেন খ্রুলেভের মাধ্যমে। তিনি তৎকালীন জ়ার দ্বিতীয় আলেকজ়ান্ডারকে নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
খ্রুলেভের পরিকল্পনা অনুযায়ী, অল্প সংখ্যক রাশিয়ান সেনা আফগানিস্তানে পৌঁছবে এবং সেখানকার বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একত্রে ব্রিটিশ ভারত আক্রমণ করবে।
খ্রুলেভের পরিকল্পনা নিয়ে চর্চা হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে রাশিয়ার বিধি ছিল বাম। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে রাশিয়া হেরে যায়। এর পর আর ভারত দখলের পরিকল্পনা হয়নি সেখানে।
বহু বছর পর আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে তার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। ভারতের সঙ্গে আর কখনও রাশিয়ার সংঘাত প্রকট হয়নি। বরং, আমেরিকা এবং রাশিয়ার দ্বন্দ্বে ভারত নিরপেক্ষ থেকেছে বরাবর।