ক্রিকেট দুনিয়ায় সমস্ত অপেক্ষার অবসান হয়েছে সোমবার রাতে। আইপিএলে পঞ্চম ট্রফিটি হাতে তুলে নিয়েছেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। লিগে আবার সেরার সেরা চেন্নাই সুপার কিংস।
চেন্নাইয়ের এই জয়ের পথে একাধিক প্রতিবন্ধকতা এসেছিল। সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বয়ং প্রকৃতি। বৃষ্টির জন্য রবিবার ফাইনাল ভেস্তে যায়। সোমবারের রিজার্ভ ডে-তে গড়ায় খেলা।
ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে হার্দিক পাণ্ড্যর গুজরাত ২১৪ রানের পাহাড়প্রমাণ রান খাড়া করে ধোনিদের সামনে। সেই রান তাড়া করতে গিয়েও বৃষ্টির বাধা পায় চেন্নাই। জয়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ১৫ ওভারে ১৭১ রান।
এই রান তাড়া করে যে রুদ্ধশ্বাস জয় চেন্নাই পেয়েছে, তার অন্যতম কারিগর রবীন্দ্র জাডেজা। শেষ দুই বলে একটি ছক্কা এবং একটি চার মেরে তিনি ম্যাচ জিতিয়েছেন। তার পর মাঠে দেখা গিয়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের বহু প্রতীক্ষিত দৃশ্য। জাডেজাকে কোলে তুলে নেন স্বয়ং ধোনি।
অথচ, গত কয়েক দিনে এই দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে কতই না গুঞ্জন! রটে গিয়েছিল, ধোনি এবং তাঁর এককালীন প্রিয় ‘শিষ্য’ জাডেজার মধ্যে নাকি ঝামেলা চলছে। জাডেজা নিজেই সেই গুঞ্জনে ঘি ঢেলেছিলেন।
যাবতীয় বিতর্কের সূত্রপাত গত ২০ মে। ঘরের মাঠে সে দিন চেন্নাইয়ের মুখোমুখি হয়েছিল দিল্লি। ধোনিদের ২২৩ রানের জবাবে যাদের ইনিংস ফুরিয়ে যায় ১৪৬ রানেই। ম্যাচের পর ধোনি এবং জাডেজাকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করতে দেখা যায়।
জাডেজা সেই ম্যাচে বল হাতে আশানুরূপ প্রদর্শন করতে পারেননি। মাত্র একটি উইকেট নিয়ে দিয়ে ফেলেছিলেন ৫০ রান। সমাজমাধ্যমে এতেই দুইয়ে দুইয়ে চার করেন অনেকে। অনুরাগীরা বলাবলি করতে শুরু করেন, ভাল বল করতে না পারায় হয়তো জাডেজাকে মাঠে বকাবকি করছিলেন ধোনি।
এই আলোচনা আরও উস্কে যায় ঠিক এক দিন পর জাডেজার একটি টুইটে। তিনি লেখেন, ‘‘কর্মের ফল আপনাকে ভুগতেই হবে। সে তাড়াতাড়ি হোক বা দেরিতে, ভুগতে হবেই।’’ কাকে উদ্দেশ করে জাডেজা এ কথা বলেছিলেন, কোন কর্মের কী ফলের কথা তাঁর মাথায় ঘুরছিল, তা স্পষ্ট নয়। তবে এতেও সমর্থকেরা ধোনির সঙ্গে গোলমালের ইঙ্গিত দেখতে পান।
জাডেজার স্ত্রী রিভাবা আবার স্বামীর টুইটটিকেই রিটুইট করে লেখেন, ‘‘নিজের পথ অনুসরণ করো।’’ বিতর্ক আরও উস্কে যায় তাতে।
এর পর সিএসকের তরফে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা একটি ছবি ঘিরে জল্পনা দানা বাঁধে। সেখানে দেখা গিয়েছিল, ধোনি দলের সকলের সঙ্গে আলোচনা করছেন। সকলে তাঁর কথা মন দিয়ে শুনছেন। কিন্তু সেই দলে জাডেজা নেই। ছবির সঙ্গে লেখা হয়েছিল, ‘‘যখন ধোনি কথা বলেন তখন কী করতে হয় আমরা জানি। আমরা তাঁর কথা শুনি, অনুসরণ করি এবং জিতি।’’
গুজরাতের বিরুদ্ধে চেন্নাইয়ের শেষ ম্যাচটিতে জাডেজা ‘সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়’-এর পুরস্কার জিতেছিলেন। পুরস্কারটির স্পনসর ছিল আপ্সটক্স। সেই পুরস্কার নেওয়ার পর তিনি টুইট করেন, ‘‘আপ্সটক্সও জানে, কিন্তু কিছু অনুরাগী জানেন না।’’ এর সঙ্গে কয়েকটি হাসির ইমোজিও দেন জাডেজা।
ওই পোস্টের মাধ্যমে জাডেজা বোঝাতে চেয়েছিলেন, তিনি যে দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, তা স্পনসর সংস্থা জানলেও অনেক অনুরাগীই মানতে চান না। তাঁর কথায় অনুরাগীদের প্রতি চাপা ক্ষোভ প্রকাশিন হয়।
চেন্নাইয়েরই একটি ম্যাচের শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জাডেজা প্রকাশ্যে ক্ষোভ বুঝিয়ে দেন। তাঁর মন্তব্য শুনে অনেকে মনে করেছিলেন, তিনি হয়তো ধোনিকে ঈর্ষা করছেন।
জাডেজা বলেছিলেন, ‘‘আমি শুনি সকলে মাহি ভাইয়ের নাম জপছেন। আমি যদি ওঁর আগে ব্যাট করতে নামি, অনুরাগীরা আমার আউট হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকেন। তবে দল যত ক্ষণ জিতছে, আমি খুশি।’’
সমর্থকদের প্রতি জাডেজার অনুযোগ ঝরে পড়েছিল প্রতিটি কথার মধ্যে। অনেকে যা শুনে বলতে শুরু করেছিলেন, জাডেজা হয়তো দলের অধিনায়কের জনপ্রিয়তাকে ঈর্ষা করছেন।
অতীতে ধোনি এবং জাডেজার পরম বন্ধুত্বের সাক্ষী থেকেছে ভারতীয় দলের সাজঘর। হাসি, ঠাট্টা, মশকরায় তাঁদের ঘনিষ্ঠতা ছিল চোখে পড়ার মতো। দু’জনে জুটি বেঁধে একাধিক ম্যাচও জিতিয়েছেন চেন্নাই এবং ভারতকে।
জাডেজাকে ‘স্যর’ উপাধিও দিয়েছিলেন এই ধোনিই। তাঁর বোলিং এবং ফিল্ডিং দক্ষতা, গোঁফের কারুকার্য, সব মিলিয়ে ‘জাড্ডু’ হয়ে উঠেছিলেন ধোনির ভরসার ‘স্যর জাডেজা’। বিপক্ষের লম্বা জুটি ভাঙতে হলেই তাঁর হাতে বল তুলে দিতেন মাহি।
আইপিএলে সেই দুই খেলোয়াড়ের মধ্যে এমন তিক্ততা, ঝগড়ার গুঞ্জনে অনেক সমর্থকই মুষড়ে পড়েছিলেন। তবে সব বিতর্কের অবসান হল সোমবার ফাইনাল জেতার পর।
জয়ের জন্য পর পর ছক্কা এবং চার মেরেই উচ্ছ্বাসে লাফাতে লাফাতে সাজঘরের দিকে ছুটে যান জাডেজা। যে ধোনি এত ক্ষণ নির্লিপ্ত হয়ে থমথমে মুখে বসেছিলেন, তিনি জাডেজাকে কোলে তুলে নেন।
অতঃপর মধুরেণ সমাপয়েৎ। যাবতীয় গুঞ্জনের ইতি হয়েছে ওই এক ফ্রেমেই। সমর্থকদের মধ্যে আরও কোনও সংশয় নেই। ধোনি এবং তাঁর প্রিয় ‘স্যর জাডেজা’ চেন্নাইয়ের জয়ের কাণ্ডারি হয়ে রইলেন সোমবারের পর।