প্রাচীন কবরস্থান খোঁড়াখুড়ি করতে গিয়ে রহস্যময় এক কঙ্কালের খোঁজ পেলেন গবেষকরা। পোল্যান্ডের গ্রামে ১৭ শতকের একটি কবরস্থানে খোঁড়াখুড়ির কাজ চালাচ্ছিল নৃতত্ত্ববিদদের একটি দল। সম্প্রতি তাঁরা এক মহিলার দেহাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। এই আবিষ্কার রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছে গবেষকমহলে।
পোল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বে ছোট্ট গ্রাম পিয়েন। গবেষণার স্বার্থেই সেখানকার এক প্রাচীন কবরস্থানে বেশ কিছু দিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ি করছিলেন স্থানীয় গবেষকদের একটি দল। তাঁরা যে মহিলার দেহাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন, মনে করা হচ্ছে তিনি কোনও সাধারণ নারী ছিলেন না। অনেকে বলছেন, তিনি ছিলেন ‘ভ্যাম্পায়ার’। যে ভঙ্গিতে মাটির নীচে ওই মৃতদেহ পোঁতা হয়েছিল, তা দেখেই এমন ধারণা তৈরি হয়েছে নানা মহলে।
দীর্ঘ দিনের মাটির আস্তরণ সরিয়ে দেখা গিয়েছে, কঙ্কালটির ঠিক গলার উপর আনুভূমিকভাবে গাঁথা একটি কাস্তে। যেন মৃত মহিলা মাটি ছেড়ে উঠে আসতে চাইলেই ধারালো অস্ত্রে কাটা পড়বে তাঁর গলা।
ওই কঙ্কালের পায়ের বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়ার মতো। তাঁর বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল অন্য আঙুলের সঙ্গে এমন ভাবে জড়ানো, যা খুব সহজে খোলা যায় না। কবর দেওয়ার আগে দুই আঙুল যেন পেঁচিয়ে দিয়েছে কেউ।
মহিলার মাথায় একটি রেশমের টুপির অবশিষ্টাংশও মিলেছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রাচীন কালে পোল্যান্ডের স্থানীয় রীতি অনুযায়ী, এই ধরনের টুপি ব্যক্তিবিশেষের সামাজিক মর্যাদা নির্দেশ করত। অর্থাৎ, মৃত মহিলা জীবৎকালে উচ্চ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
কঙ্কালটির মুখগহ্বরে অক্ষত রয়েছে দাঁত। তবে উপরের পাটির মাঝখানের একটি দাঁতের গড়ন যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন গবেষকরা। ওই দাঁতটি খুব উঁচু এবং বড়। ভ্যাম্পায়ারের দাঁতের গড়নের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে এই দাঁতের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন কেউ কেউ।
পোল্যান্ডের টোরান শহরের নিকোলাস কোপারনিকাস ইউনিভার্সিটির গবেষক দলের প্রধান ডারিয়ুসজ পোলিনস্কি বলেছেন, ‘‘যে ভঙ্গিতে ওই মৃতদেহ পোঁতা হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক। প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী, মৃত্যুর পর কারও ফিরে আসা আটকাতে মৃতদেহ কবর দেওয়ার সময় বেশ কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করা হত। মৃতের পা অথবা মাথা কেটে ফেলা, দেহ পুড়িয়ে ফেলা, উপুড় করে মাটিতে মাথা গুঁজে দেওয়া অথবা বড় পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া এই পন্থাগুলির মধ্যে ছিল অন্যতম।’’
মৃত্যুর পর ফিরে আসা ঠেকাতেই ওই মহিলার বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল অন্য আঙুলের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, মনে করছেন পোলিনস্কি।
পূর্ব ইউরোপে খ্রিস্টীয় ১১ শতক নাগাদ মানুষের বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুর পরেও কবর ভেদ করে উঠে আসতে পারে মৃত ব্যক্তি। ‘রক্তচোষা শয়তান’ বা ‘ভ্যাম্পায়ার’ হিসাবে সেটাই হত তার নবজন্ম। মাটি ফুঁড়ে উঠে প্রচলিত জীবনধারায় ব্যাঘাত ঘটাত তারা।
পোল্যান্ডের ওই কবরস্থানেই আরও একাধিক নরকঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে যাদের মাথা ধাতব রড দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল। মানুষের বিশ্বাস ছিল, এ ভাবে মৃতদেহে আঘাত করলে তারা মৃত্যুতেই থমকে থাকে। আর ফিরে আসার চেষ্টা করে না।
পূর্ব ইউরোপের একাংশের মানুষ ভ্যাম্পায়ারের ধারণায় বিশ্বাস করতেন। সে ধারণা এক সময় এতটাই বদ্ধমূল হয়েছিল যে, সন্দেহের ভিত্তিতেও মেরেও ফেলা হত অনেককে। তা ছাড়া, আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনায় কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হলেও ভ্যাম্পায়ার হিসাবে তিনি আবার ফিরে আসতে পারেন বলে মনে করা হত। তাঁদের ক্ষেত্রে মৃতদেহ কবর দেওয়া হত বিশেষ উপায়ে।
এর আগে ২০১৫ সালে পিয়েন থেকে দু’শো কিমি দূরের এক গ্রামে ৪০০ বছরের পুরনো কবরস্থান খুঁড়ে একই ভঙ্গিতে পোঁতা পাঁচটি কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। ঠিক গলার উপরে গাঁথা ছিল কাস্তে। এক বয়স্ক মহিলার কঙ্কালের পশ্চাদদেশে কাস্তে এবং গলার কাছে পাথর গাঁথা হয়েছিল।
কখনও ১৪ বছরের কিশোরী কখনও ৩৫ বছরের যুবক, কখনও আবার ৬০ বছর বয়সি বৃদ্ধা। পোল্যান্ডের নানা প্রান্তে এমন নানা কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে বার বার।
গবেষকদের একাংশ অবশ্য এই ধরনের কবরের অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেছেন, মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, তিনি যাতে নিশ্চিন্তে মাটির তলায় বিশ্রাম নিতে পারেন, সেই ভেবেই ধারালো কাস্তে, পাথরের সুরক্ষা দেওয়া হত তাঁদের কবরে।
কেউ কেউ বলছেন, স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, ডাইনি প্রথা কিংবা কালো জাদুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মৃতদেহ কবরের সময় এমন ব্যবস্থা করা হত।