ভারতের শিল্পজগতে নক্ষত্র পতন। প্রয়াত টাটা সন্সের চেয়ারম্যান এমেরিটাস রতন টাটা। ৮৭ বছর বয়সে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুম্বইয়েই হয়েছে তাঁর শেষকৃত্য।
টাটা গোষ্ঠীকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন রতন টাটা। তাঁর প্রপিতামহ প্রবাদপ্রতিম জামশেদজি টাটা হলেন এই শিল্পসংস্থার প্রাণপুরুষ। যদিও তাঁর পরিবারের সবাই বরাবরই প্রচারের আলো থেকে দূরে থেকেছেন।
টাটা পরিবার প্রচারবিমুখ হওয়ায় তাঁদের সম্পর্কে আমজনতার ধারণা খুবই কম। রতন টাটার প্রয়াণের পর তাঁর পরিবারের অনেক কথাই প্রকাশ্যে এসেছে। তাঁর বাবা ছিলেন নাভাল টাটা।
রতন টাটার বাবা নাভাল আবার ছিলেন দত্তক পুত্র। রতনজি টাটা তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন। যাঁকে সারা দুনিয়া চেনে জামশেদজির ছেলে হিসাবে।
টাটা পরিবারের আদিপুরুষ ছিলেন নুসেরওয়ানজি টাটা। তিনি এই টাটা বংশকে এগিয়ে নিয়ে যান। ব্যক্তিগত জীবনে নুসেরওয়ানজি ছিলেন পার্সি পুরোহিত। তবে টাটা পরিবারের প্রথম সদস্য হিসাবে তিনিই ব্যবসার জগতে পা রাখেন।
নুসেরওয়ানজির পুত্র হলেন জামশেদজি টাটা। গুজরাতের নবসারির বাসিন্দা ছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে মুম্বই চলে আসেন জামশেদজি। তার পরই তাঁর ভাগ্য খুলে যায়।
পুত্রকে আধুনিক তথা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন নুসেরওয়ানজি। আর তার জন্য খুব অল্প বয়সে জামশেদজিকে মুম্বই পাঠিয়ে দেন তিনি। সেখানকার এলফিনস্টোন কলেজ থেকে ‘গ্রিন স্কলার’ হিসাবে সসম্মানে উত্তীর্ণ হন টাটা গোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ।
প্রথম জীবনে ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত বাবার সঙ্গেই ব্যবসার কাজ দেখাশোনা করতেন জামশেদজি। ১৮৬৮ সালে ব্যবসায়িক সংস্থা হিসাবে টাটা গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। মাত্র ২১ হাজার টাকা পুঁজি সম্বল করে সংস্থাকে ধীরে ধীরে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
জামশেদজিকে ‘ভারতীয় শিল্পের জনক’ বলা হয়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পার্সি পরিবারের সন্তান জানতেন নতুন নতুন ব্যবসার দুনিয়ায় প্রবেশ করার কৌশল। একেবারে শুরুর দিকে জাহাজ সংক্রান্ত কাজ করত টাটা গোষ্ঠী।
কিন্তু সংস্থা তৈরির এক বছরের মাথায় কাপড়ের ব্যবসায় পা রাখেন জামশেদজি। মুম্বই (তৎকালীন বম্বে) তখন দেশের বস্ত্রশিল্পের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই জামশেদজির পসার জমে উঠেছিল।
পরবর্তী কালে মুম্বইয়ের কোলাবায় ‘তাজমহল হোটেল’ খোলেন জামশেদজি। এটিই ছিল দেশের প্রথম হোটেল, যেখানে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হত। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এবং টাটা স্টিল তৈরির ক্ষেত্রেও তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য অবদান রয়েছে।
১৯০৪ সালে জার্মানিতে মৃত্যু হয় জামশেদজি টাটার। তাঁর বড় ছেলে ছিলেন দোরাবজি টাটা। বাবার মৃত্যুর পর তিনিই ব্যবসার হাল ধরেন। টাটা স্টিল ও টাটা পাওয়ারকে কলেবরে বড় করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দোরাবজির ছোট ভাই তথা জামশেদজির কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন রতনজি টাটা। এই শিল্পগোষ্ঠীর তুলো ও বস্ত্র ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি।
সুজ়ান ব্রিয়ার নামের এক ফরাসি মহিলাকে বিয়ে করেন রতনজি। এই দম্পতির সন্তানের নাম জাহাঙ্গির রতনজি দাদাভয় টাটা। জেআরডি টাটা নামেই শিল্পজগতের তিনি বেশি পরিচিত।
প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন জেআরডি। সাল-তারিখের হিসাবে যা ১৯৩৮ থেকে ১৯৯১। জেআরডি টাটার ছিল আকাশে ওড়ার শখ। ফলে বিমান চালানোও শিখে নেন তিনি।
ভারতের প্রথম বাণিজ্যিক পাইলটের তালিকায় প্রথম নামটি হল জেআরডি টাটার। টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান থাকাকালীন বিমান পরিষেবা চালু করেন তিনি। পরবর্তী কালে যার নাম হয় ‘এয়ার ইন্ডিয়া’।
টাটা গ্রুপকে বহুজাতিক সংস্থায় পরিণত করার বীজ বুনেছিলেন জেআরডি টাটা। তাঁর বাবা রতনজি টাটা দত্তক সন্তান গ্রহণ করেন। তাঁরই নাম নাভাল টাটা। তিনি এই শিল্প সংস্থার উন্নতিতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর নাভাল টাটার স্ত্রী সুনির কোলে আসে এক পুত্রসন্তান। পালক পিতার নামানুসারে তার নাম রতন টাটা রাখেন নাভাল। ১৯৯১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টাটা গ্রুপের অন্তর্বর্তিকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন রতন টাটা। এই শিল্প সংস্থাকে পুরোপুরি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে রূপান্তরিত করেন তিনি।
জেআরডি টাটার প্রতিষ্ঠা করা বিমান সংস্থা স্বাধীনতার পর সরকারি মালিকানাধীনে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়াকে কিনে আবার তা টাটা গোষ্ঠীর কাছেই ফিরিয়ে আনেন রতন টাটা।
বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা ফোর্ডের তৈরি ল্যান্ড রোভার ও জাগুয়ারকে টাটা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রেও রতন টাটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ২০০০ সালে পদ্মভূষণ ও ২০০৮ সালে পদ্মবিভূষণে তাঁকে সম্মানিত করে ভারত সরকার।
রতন টাটার ভাইয়ের নাম জিম্মি। দাদার মতো তিনিও আজীবন অকৃতদার থেকে গিয়েছেন। আর রতন টাটার সৎভাইয়ের নাম নোয়েল টাটা। ১৯৫৭ সালে তাঁর জন্ম। টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি দীর্ঘ দিন জড়িত ছিলেন।
নোয়েল বিয়ে করেছেন আলু মিস্ত্রিকে। এই দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে। তাঁরা হলেন, নেভিল, লিয়া ও মায়া। মানসী কিরলোস্কারের সঙ্গে সংসার পেতেছেন নেভিল। আর বর্তমানে স্পেনে পড়াশোনা করছেন লেহ্। নোয়েলের তিন সন্তানের প্রত্যেকেই টাটা গ্রুপের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন।