উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের কাছে পৌঁছনো গিয়েছে। এ বার একে একে বার করে আনা হবে ৪১ জনকে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যেই সেই কাজ সম্পন্ন হতে পারে।
বদ্ধ সুড়ঙ্গে টানা ১৭ দিন আটকে ছিলেন শ্রমিকেরা। গত ১২ নভেম্বর ভোরে সুড়ঙ্গে ধস নেমে তাঁরা আটকে পড়েন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা গেলেও উদ্ধার করা যাচ্ছিল না।
সুড়ঙ্গে ধস নেমে ৬০ মিটার ধ্বংসস্তূপের পিছনে আটকে ছিলেন শ্রমিকেরা। যন্ত্রের মাধ্যমে সেই ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু বাধা আসছিল বার বার।
কখনও সুড়ঙ্গে ধস নেমে, কখনও যন্ত্র খারাপ হয়ে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হয়েছিল। গত শুক্রবার আমেরিকান খননযন্ত্রটি ধ্বংসস্তূপের ভিতরে লোহার কাঠামোয় ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যায়।
যন্ত্রটি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, তা আর মেরামত করা যায়নি। ফলে থমকে যায় উদ্ধারকাজ। ওই ২৫ টন ওজনের ভাঙা যন্ত্রের অংশগুলি বার করাই উদ্ধারকারীদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অবশেষে সোমবার যন্ত্রাংশ বার করে আনা হয়। সুড়ঙ্গে এর পর নামেন খনি শ্রমিকেরা। ঠিক হয়, আর যন্ত্র নয়, এ বার অন্য পদ্ধতিতে ধ্বংসস্তূপ খোঁড়া হবে।
এই পদ্ধতির নাম ‘র্যাট-হোল মাইনিং’। খনি থেকে আকরিক উত্তোলন, বিশেষত কয়লাখনির কাজে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হত। কিন্তু পরে তা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
সেই নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে ভরসা রেখেই সাফল্য মিলেছে উদ্ধারকাজে। সোমবার থেকে উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ শুরু হয়। মঙ্গলবারের মধ্যে উদ্ধারকাজ সফল হল।
কী এই ‘র্যাট-হোল মাইনিং’? কেনই বা খনিতে তা নিষিদ্ধ? নাম শুনেই আন্দাজ করা যায়, ইঁদুরের কায়দায় গর্ত খোঁড়ার সঙ্গে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এর সম্পর্ক রয়েছে।
কয়লাখনিতে অতি ক্ষুদ্র কিছু গর্ত খুঁড়ে কয়লা উত্তোলন করার প্রক্রিয়াকে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ বলে। এই প্রক্রিয়ায় চার ফুটের বেশি গভীর গর্ত খোঁড়া হয় না।
খনি শ্রমিকেরা কয়লার ভান্ডারের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে পাশ থেকে এই ধরনের গর্ত খোঁড়া হয়। সরু, ছোট সুড়ঙ্গ বেয়ে কয়লার কাছে পৌঁছে যান শ্রমিকেরা। তার পর কয়লা তুলে বাইরে আনা হয়।
এই প্রক্রিয়ায় মূল ঝুঁকির কারণ হল, সুড়ঙ্গ অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়। ফলে যে কোনও মুহূর্তে ধস নেমে শ্রমিকের মৃত্যু হতে পারে। ‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এ সাধারণত শাবল-গাঁইতির মতো ছোট জিনিস ব্যবহার করা হয়।
মেঘালয়ে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ খুব প্রচলিত এবং শ্রমিকদের মধ্যে জনপ্রিয়। কারণ, সেখানে কয়লার উপরের খনির স্তর বেশ পাতলা। অর্থনৈতিক কারণেও অন্য পদ্ধতি ব্যবহারে সমস্যা আছে সেখানে।
‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এ সুড়ঙ্গের আকার ছোট এবং সংকীর্ণ হওয়ার কারণে এই পদ্ধতিতে শিশু শ্রমিক ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যেত। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা বাধ্য হয়ে এই কাজে যোগ দিত। শুধু তাই নয়, এই কাজ করার জন্য অনেক শিশুর বয়স বাড়িয়ে দেখানো হত।
ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল ২০১৪ সালে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর ফলে বহু শ্রমিকের প্রাণ গিয়েছে। একে অবৈজ্ঞানিক বলে অভিহিত করা হয়।
নিষিদ্ধ করার পরেও অবশ্য এই পদ্ধতির ব্যবহার বন্ধ হয়নি। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে প্রায়ই ‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এর মাধ্যমে কয়লা তোলা হয়। ২০০৮ সালে মেঘালয়ে এই পদ্ধতির কারণেই বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে।
বেআইনি কয়লা উত্তোলনের সময়ে ১৫ জন শ্রমিক খনির ভিতরে আটকে গিয়েছিলেন। বন্যার জলে ভেসে গিয়েছিল সেই খনি। দু’মাস ধরে চলেছিল উদ্ধারকাজ। কেবল দু’জনের দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। বাকিদের কোনও খোঁজ মেলেনি।
২০২১ সালেও ‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এর কারণে মেঘালয়ে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। বন্যায় খনির ভিতর ধস নেমে আটকে গিয়েছিলেন পাঁচ জন। তিন জনের দেহ উদ্ধার করা গিয়েছিল।
নিষিদ্ধ সেই ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ উত্তরকাশীতে সাফল্য এনে দিয়েছে। অন্য সব পথ যখন বন্ধ, তখন ওই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন উদ্ধারকারীরা। ১০-১২ মিটার বাকি থাকতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এর জন্য উত্তরকাশীতে সোমবার ডেকে আনা হয়েছিল খনি বিশেষজ্ঞদের। ১২ জন শ্রমিক সেখানে কাজ করেছেন। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় গর্ত খুঁড়ে আটকে থাকা ৪১ শ্রমিকের কাছে পৌঁছন তাঁরা।