শিরোনামে পৃথ্বীরাজ চৌহান। সৌজন্যে অবশ্যই বলিউড। সম্প্রতি অক্ষয় কুমার অভিনীত এবং চন্দ্রপ্রকাশ দ্বিবেদী পরিচালিত ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’ নিয়ে গণকৌতূহলের পারদ খানিক ঊর্ধ্বগামী। চৌহান বংশীয় রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজকে নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে কৌতূহল বরাবরই জাগরূক।তিনি এমনই এক নৃপতি, যাঁর বীরত্বের কাহিনি প্রায় মহাকাব্যিক স্তরের। তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে একাধিক কাব্য। কিন্তু কাব্য আর কিংবদন্তির পৃথ্বীরাজ কি ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্রটির অনুরূপ? এই প্রশ্নও বারবার উঠেছে।
পৃথ্বীরাজের জীবন সম্পর্কে প্রাথমিক ভাবে জানা যায় তিনটি মধ্যযুগীয় কাব্য থেকে— কবি চাঁদ বরদাই কর্তৃক ব্রজভাষায় রচিত ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’, জৈন কবি নয়চন্দ্র সুরী কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ‘হাম্মীর মহাকাব্য’ এবং সংস্কৃত ভাষাতেই লিখিত কাব্য ‘পৃথ্বীরাজ বিজয়’ (অনুমান করা হয় পৃথ্বীরাজের সভাকবি তথা ইতিহাসকার জয়ানকের লেখা) থেকে। কিন্তু, এই তিনটি সূত্রই বেশ ভাল রকম কিংবদন্তি-আশ্রিত। এগুলি থেকে পৃথ্বীরাজের প্রকৃত জীবনকাহিনি উদ্ধার করা দুরূহ।
এই তিন কাব্যের পাশাপাশি রয়েছে ইসলামি ‘তারিখ’ (কালপঞ্জি) রচয়িতাদের লিখিত বিবরণ। এর বাইরে সমসাময়িক বা পরবর্তী রাজাদের কিছু শিলালেখ থেকেও তাঁর সম্পর্কে জানা যায়। সমস্ত সূত্র থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেটি পৃথ্বীরাজের বীরত্ব।
চৌহান বা চহমান রাজা সোমেশ্বর ও রানি কর্পূরদেবী (মধ্য ভারতের কলচুরি রাজবংশের কন্যা)-র সন্তান ছিলেন পৃথ্বীরাজ। চৌহান বা চহমানরা বর্তমান রাজস্থানের একাংশে রাজত্ব করতেন। তাঁদের রাজধানী ছিল অজমেঢ়। ভারততত্ত্ববিদ দশরথ শর্মা (১৯০৩-১৯৭৬) পৃথ্বীরাজের জন্মসন ১২২৩ বিক্রম সম্বৎ বা ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দ বলে নির্ণয় করেছেন।
‘পৃথ্বীরাজ বিজয়’ থেকে জানা যায়, পিতা সোমেশ্বর তাঁকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। পৃথ্বীরাজ বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন এবং সমকালীন বিদ্যাচর্চার অনেকগুলি শাখাতেই ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। এর বাইরে, এক অতুলনীয় ধনুর্বিদ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন পৃথ্বীরাজ। তিনি ধনুর্বিদ্যার বহু দুরূহ কৌশলও নাকি রপ্ত করেছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল শব্দভেদী বাণ চালনা।
পৃথ্বীরাজের বাল্যকাল কেটেছিল গুজরাতে। পরে তিনি বাবার সঙ্গে অজমেঢ়ে চলে আসেন। ১১৭৭ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর বাবা সোমেশ্বরের মৃত্যু হয়, তখন তিনি ১১ বছর বয়সের বালকমাত্র। তখনই তাঁকে সিংহাসনে আরোহণ করতে হয়। অবশ্য নাবালক পৃথ্বীরাজের অভিভাবিকা হিসেবে তাঁর মা কর্পূরদেবীই রাজ্য পরিচালনা করতেন বলে জানা যায়।
যে সময় পৃথ্বীরাজ চৌহান বংশের সিংহাসনে বসেন, সেই সময় তাঁদের বংশে বিবিধ গোলযোগ চলছিল। সোমেশ্বরের অকালমৃত্যুর সুযোগ নিয়ে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র নাগার্জুন রাজ্যের একাংশ দখল করেন ( সম্ভবত বর্তমান গুরুগ্রাম)।
পৃথ্বীরাজ বিপুল বাহিনী নিয়ে নাগার্জুনকে আক্রমণ করেন এবং নাগার্জুন পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। বিজয়ী পৃথ্বীরাজ অজমেঢ়ে ফিরে আসেন। ‘পৃথ্বীরাজ বিজয়’ অনুসারে, যুদ্ধে নিহত শত্রুপক্ষীয় সৈন্যদের মুণ্ড দিয়ে মালা গেঁথে অজমেঢ় দুর্গের তোরণের বাইরে টাঙিয়ে দেওয়া হয়।
পৃথ্বীরাজ এর পর বুন্দেলখণ্ডের চান্দেলা রাজ্য আক্রমণ করেন এবং তার পর গুজরাতের চালুক্যদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হন। এই সব যুদ্ধে পৃথ্বীরাজের শৌর্যের কাহিনি বিভিন্ন ভাবে অতিরঞ্জিত হতে থাকে। তিনি এক প্রবল পরাক্রান্ত বীর হিসেবে দূর-দূরান্তরেও স্বীকৃত হতে শুরু করেন।
কনৌজের গহড়বাল রাজ্যের সিংহাসনে তখন জয়চন্দ্র বা জয়চাঁদ আসীন। তিনিও প্রবল প্ররাক্রান্ত নৃপতি ছিলেন। ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’-র বিবরণ অনুযায়ী, জয়চাঁদের কন্যা সংযুক্তাকে পৃথ্বীরাজ হরণ করেছিলেন। এবং সেই থেকেই তাঁদের মধ্যে ঘোরতর শত্রুতার সূত্রপাত হয়।
কালে কালে বিবিধ কিংবদন্তিতে ছড়িয়ে যায় পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তার প্রণয়- কাহিনি। কিংবদন্তি জানায়, জয়চাঁদ নাকি তাঁর বৈভব ও পরাক্রম ব্যক্ত করতে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। পৃথ্বীরাজ সেই যজ্ঞে আমন্ত্রিত হলেও সেখানে যেতে অস্বীকার করেন। কারণ তিনি জয়চাঁদের একচ্ছত্র আধিপত্যকে মেনে নিতে রজি ছিলেন না।
অন্য দিকে আবার পৃথ্বীরাজের বীরত্বের কথা শুনে সংযুক্তা তাঁর প্রেমে পড়েন এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবেন না বলে স্থির করেন। ইতিমধ্যে সংযুক্তার জন্য এক স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেন জয়চাঁদ। কিন্তু তিনি পৃথ্বীরাজকে সেই সভায় আমন্ত্রণ জানাননি। পৃথ্বীরাজ বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে কনৌজ আক্রমণ করেন এবং সংযুক্তাকে হরণ করে দিল্লি নিয়ে আসেন।
দ্বাদশ শতক থেকেই বিভিন্ন মুসলিম রাজশক্তি ভারতে ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা চালাতে শুরু করে। গজনির ঘুরি শাসকদের সঙ্গে চৌহানদের সীমান্ত সঙ্ঘাত দীর্ঘ কাল ধরেই বিদ্যমান ছিল। ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরি সিন্ধু নদ অতিক্রম করে মুলতান দখল করেন এবং গুজরাতের চালুক্য রাজ্য আক্রমণে উদ্যত হন। এই সময়েই চৌহান বংশীয়দের সঙ্গে তাঁর সম্মুখসমর অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ, চৌহানদের এড়িয়ে গুজরাত অভিযান ঘুরির পক্ষে সম্ভব ছিল না।
১১৯০-১১৯১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মহম্মদ ঘুরি চৌহান রাজ্য আক্রমণ করে বর্তমান ভাতিন্ডা দখল করেন। পৃথ্বীরাজ এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে ভাতিন্ডার দিকে অগ্রসর হন এবং তরাইনের প্রান্তরে ঘুরির বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন।
পৃথ্বীরাজ মনে করেছিলেন, এই পরাজয় মেনে নিয়ে ঘুরি অভিযান থেকে নিরস্ত হবেন। কিন্তু ঘুরির পরিকল্পনা ছিল অন্য। তিনি গজনি ফিরে যান এবং আরও বড় এক সেনাদল নিয়ে চৌহান রজ্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এই অভিযানে জম্মুর রাজা বিজয়রাজ ঘুরিকে সাহায্য করেছিলেন বলে জানা যায়।
তরাইনের প্রান্তরে ঘুরির বাহিনী চৌহান সেনাদলকে পরাস্ত করে এবং পৃথ্বীরাজকে বন্দি করে। পৃথ্বীরাজের পরাজয় সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করে। জানা যায়, সারা দিনের যুদ্ধের পর রণক্লান্ত পৃথ্বীরাজকে ঘুমন্ত অবস্থায় আক্রমণ করে বন্দি করা হয়। আবার কোনও সূত্র অনুসারে, পৃথ্বীরাজ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু শ্রাবস্তীর কাছে তিনি ঘুরির সেনাদের হাতে বন্দি হন।
পৃথ্বীরাজ-কিংবদন্তি জানায়, মহাপরাক্রান্ত বীর সংযুক্তাকে বিয়ের পর তাঁর প্রতি এতই আসক্ত হয়ে পড়েন যে, রাজকার্য বা সেনা পরিচালনা ছেড়ে প্রাসাদে প্রমোদমত্ত জীবন কাটাতে শুরু করেন।
চাঁদ বরদাইয়ের কাব্য অনুসারে, সংযুক্তা পৃথ্বীরাজকে বারবার রাজধর্ম পালনের কথা মনে করিয়ে দিলেও প্রেমোন্মত্ত রাজা তাতে কর্ণপাত করেননি। শেষে বরদাইয়ের অনুরোধেই তিনি পুনরায় অস্ত্র ধারণ করেন। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। পৃথ্বীরাজ তাঁর পরাক্রম হারিয়েছেন।
বন্দি হওয়ার পরে পৃথ্বীরাজকে ঘুরি অজমেঢ়ে ফিরিয়ে আনেন এবং তাঁর সামন্ত হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই স্বাধীনচেতা পৃথ্বীরাজ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ঘুরি তাঁকে হত্যা করেন।
কিন্তু কিংবদন্তি পৃথ্বীরাজের শেষ জীবন সম্পর্কে অন্য কথা জানায়। বিশেষ করে চাঁদ বরদাইয়ের কাব্য জানায় যে, ঘুরি পৃথ্বীরাজকে গজনিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবং সেখানে তাঁকে অন্ধ করে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে অন্ধ পৃথ্বীরাজের সঙ্গে ঘুরির সখ্য জন্মায়। পৃথ্বীরাজকে কারাকক্ষের বাইরে ঘোরাফেরার অনুমতি দেওয়া হয়।
এই অবস্থায় এক তিরন্দাজি প্রতিযোগিতায় অন্ধ পৃথ্বীরাজ শব্দভেদী তির নিক্ষেপের খেলা দেখাতে রাজি হন। সেখানেই ঘুরির কণ্ঠস্বর শুনে শব্দভেদী বিদ্যা প্রয়োগ করে পৃথ্বীরাজ তাঁকে তির ছুড়ে হত্যা করেন। কবি বরদাই নাকি সেখানে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন এবং পৃথ্বীরাজের নির্দেশে তিনি পৃথ্বীরাজকে হত্যা করে আত্মঘাতী হন। ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’ কাব্য সমাপ্ত করেন চাঁদ বরদাইয়ের পুত্র।
এই কিংবদন্তির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে ঘুরি এক আততায়ীর দ্বারা নিহত হন। এই ‘আততায়ী’ পৃথ্বীরাজ কি না, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ঘুরির মৃত্যুর বহু আগেই পৃথ্বীরাজ মারা গিয়েছিলেন।
ইতিহাস এ-ও জানায় যে, সংযুক্তা পৃথ্বীরাজের একমাত্র পত্নী ছিলেন না। পৃথ্বীরাজ তিনটি বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’-র কল্যাণে সংযুক্তা-পৃথ্বীরাজের প্রেমকাহিনি লায়লা-মজনু বা সোহনি-মাহিওয়ালের প্রেমগাথার মতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই গাথাগুলি জানায় যে, পৃথ্বীরাজের মৃত্যুর পরে সংযুক্তা জৌহর ব্রত পালন করে আত্মহত্যা করেন।
ইতিহাস আর কিংবদন্তিতে আচ্ছন্ন পৃথ্বীরাজ গণচিত্তে রয়ে গিয়েছেন এক জন বীর হিসেবে। পরবর্তী কালে তাঁকে ‘হিন্দুস্তান’-এর 'স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করা হতে থাকে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, পৃথ্বীরাজের কালে ‘হিন্দুস্তান’ বলে অখণ্ড কোনও রাষ্ট্র ছিল না। পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত অগণিত রাজ্যে বিভাজিত পশ্চিম ভারতকেই ঘুরি আক্রমণ করেছিলেন। আর পৃথ্বীরাজ লড়াই করেছিলেন চৌহান রাজ্যের জন্য। ‘হিন্দুস্তান’-এর ধারণা তাঁরও ছিল না।